- বইয়ের নামঃ গহীন জঙ্গলে কুয়াশা
- লেখকের নামঃ কাজী আনোয়ার হোসেন
- সিরিজঃ কুয়াশা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী বই
- বিভাগসমূহঃ কল্পকাহিনী, রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প, অ্যাডভেঞ্চার, গোয়েন্দা কাহিনী, অ্যাকশন
গহীন জঙ্গলে কুয়াশা
কুয়াশা ২ (ভলিউম ১)
টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়েই চলেছে আজ ছসাতদিন ধরে। শ্রাবণের মাঝামাঝি। একবার শুরু হলে আর থামতেই চায় না।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। Dienfa Workshop-এ অষ্টিন এইট ফিটি গাড়িটা অয়েলিং করবার জন্যে রেখে শহীদ পায়ে হেটে বাড়ি ফিরছে। ওয়াটারপ্রুফ পরা, পায়ে গাম -বুট, মাথায় টুপি। ভিজবার কোনও ভয় নেই। বৃষ্টিটা বেশ একটু চেপে এলো। শান্তিনগরের বিরাট পিচ ঢালা রাস্তাটা এমনিতেই খুব নির্জন থাকে। বৃষ্টির দিন, তাই লম্বা রাস্তাটা ধরে যতদূর দেখা যায়, জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই।
বেশ দূরে একজন লোককে হেঁটে আসতে দেখা গেল। ভিজে আসছে লোকটা। অনেকটা কাছে আসতেই শহীদ দেখলো, নিগ্রো একজন। ছ্যাৎ করে উঠলো তার বুকের ভিতরটা। গত কয়েকদিন ধরে জনকতক নিগ্রো তার ওপর নজর রাখছে। সে যেখানেই যায় ছায়ার মতো পিছু নেয় তাদের কেউ না কেউ। এ লোক তাদেরই দলের একজন।
কাছে এসে শহীদকে চিনতে পেরে সব কটা দাঁত বেরিয়ে গেল লোকটার। একটা মিষ্টি হাসি দিলো সে। শহীদের কাছে কিন্তু হাসিটা মােটেই মিষ্টি লাগলো না। নিকষ কালো মুখে চকচকে সাদা দাঁতগুলো ওকে যেন ভেংচি কাটলো। কী বীভৎস চেহারা!
শহীদ গম্ভীর মুখে এগিয়ে যায়। পকেটের মধ্যে রিভলবারটা শক্ত করে চেপে ধরেছে সে। শহীদ ভাবে, কেন এই লোকগুলো তার পিছন ধরেছে? কী এদের উদ্দেশ্য? এমন বিকট হাসিরই বা অর্থ কি? ঢাকার বুকে হঠাৎ এতগুলো নিগ্রো কোথা থেকে এসে হাজির হলো?
দ্রুত হাঁটছে শহীদ। মাঝে মাঝে পিছন ফিরে চায়। না, কেউ নেই আশেপাশে। প্রায় বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে সে। সামনে একটা মাঠ আর একটা বড় দীঘি বাঁ পাশে রেখে একটা কাঁকরের সরু পথ শহীদের সুন্দর একতলা বাড়িটার গেট পর্যন্ত চলে গেছে। বৈঠকখানার কাঁচের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ঘরের মধ্যে মহুয়া, কামাল আর লীনা বসে গল্প করছে। ওদের দেখে শহীদের বুকের ওপর থেকে একটা ভারি পাথর যেন সরে গেল। মনটা হালকা হয়ে গেল। ডান পাশে একটা বাড়ি তৈরি হচ্ছে। জায়গাটা অন্ধকার মতো। তারপরেই কাঁকরের রাস্তায় পড়বে সে।
হঠাৎ পিছন থেকে কে একজন সাপটে ধরলো তাকে। শহীদ ছাড়াবার চেষ্টা করছে এমন সময় বাঁ পাশ থেকে প্রচণ্ড এক মুষ্ট্যাঘাত এসে পড়ল তার গালে। বোঁ করে ঘুরে উঠলো তার মাথাটা। কেমন যেন ঘোলাটে লাগছে। সামলে নেয়ার আগেই তার পকেট থেকে রিভলবার তুলে নিলো আক্রমণকারী। শহীদ ততোক্ষণে সামলে নিয়েছে অনেকটা। চেয়ে দেখলো তাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে চার-পাঁচজন নিগ্রো! তাদের মধ্যে সবচাইতে লম্বা লোকটা এগিয়ে এসে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বললো, Dont shout. Otherwise you dead. Comes with me.
শহীদ চিন্তা করে দেখলো ওয়াটারপ্রুফ পরে, গামবুট পায়ে চার পাঁচজন ষন্ডামার্কা নিগ্রোর সাথে লাগতে যাওয়া পাগলামি ছাড়া কিছুই নয়। তাকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে তারা অর্ধেক তৈরি বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেল।
শহীদ শেষ বারের মতো তার বাড়ির দিকে চেয়ে দেখলো কামাল, মহুয়া, লীনা তেমনি গল্প করছে। গফুর চা নিয়ে এসে রাখছে টেবিলের ওপর। এতো কাছে রয়েছে ওরা তবু কেউ জানছে না শহীদের এখন কতো বড় বিপদ। ক্ষোভে দুঃখে শহীদের হাসি পেলো। ইশ! গকুর যদি একটু জানতে পারতো তার দাদামণি এখন কতো বড় বিপদে পড়েছে। গফুর আর শহীদ একসাথে থাকলে এই নিগ্রো কজন টের পেতে কার সাথে লাগতে গেছে ওরা।
ঘরের মধ্যে এনে শহীদকে একটা রশি দিয়ে পিছমােড়া করে বেঁধে ফেললো ও। তারপর হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে নিজেদের ভাষায় কি যেন বিড়বিড় করে বলতে লাগলো। শহীদ তার একবর্ণও বুঝলো না। মিনিট কয়েক ওরা সেইভাবে অনবরত বলেই গেল। তারপর একজন উঠে গিয়ে ঘরের কোণে রাখা একটা লম্বা বাক্সের ডালা খুলে ফেললো। সেই লম্বা লোকটা এবার তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বাক্সের দিকে চললো। শহীদের বুঝতে বাকি রইলো না, এবার তাকে বাক্সে পোরা হবে।
হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে ঝড়ের মতো একটা মূর্তি ঢুকলো ঘরে। কালো আলখাল্লা পরা, মুখে মুখোশ। কেউ ভালো করে কিছু বুঝবার আগেই সে পটাপট কয়েকটা ঘুসি চালিয়ে দিলো তিনজন কাফ্রির নাকের ওপর। কী প্রচণ্ড ঘুসি! যেমন বিরাট লম্বা চওড়া মূর্তি, তেমনি তার ঘুসির ওজন। নাকে হাত দিয়ে বসে পড়লো তিনজনই। সবচাইতে জোয়ান নিগ্রোটা শহীদকে ফেলে দিলে মাটিতে। তারপর ঘুসি বাগিয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটে গেল মূর্তিটার দিকে। সামান্য সরে গিয়ে কি যেন একটু করলো আগন্তুক। ছিটকে ওপাশের দেয়ালে অত্যন্ত জোরে ধাক্কা খেলো জোয়ান নিগ্রোটা।
মাথাটা ভীষণভাবে ঠুকে গেছে দেয়ালের গায়ে। টু শব্দটি না করে সে ঝুপ করে মাটিতে পড়ে গেল অজ্ঞান হয়ে। এদিকে বাকি তিনজনের একজন টলতে টলতে উঠে দাড়িয়েছে। তলপেটে প্রচণ্ড এক লাথি খেয়ে সে আবার মাটিতে ঘুরে পড়লো।
সর্দারের পকেট থেকে শহীদের রিভলভারটা বের করে নিলো আগন্তুক। এবার সে শহীদের দিকে এগিয়ে আসছে। পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে শহীদের হাত পায়ের বাঁধন কেটে দিলো। তারপর পরিষ্কার বাংলায় বললো, চলো, তোমাকে কিছুদূর এগিয়ে। দিয়ে আসি।