ব্যস এটুকুই। আর এরপর উইনস্টনের ভেতর আবারও অনিশ্চয়তা ভর করলো, আসলেই কি ঘটনাটি এমন ঘটেছে! এ ধরনের ঘটনা কখনোই কোনো পরিণতি পায় না। যা হয়, তা হচ্ছে- ভেতরে একটা বিশ্বাস অথবা প্রত্যাশা জাগ্রত হয় এই ভেবে যে, সে ছাড়া অন্যরা দলের শত্রু। ব্যাপক গোপণ ষড়যন্ত্রের যে গুজব, তা সত্যি হতেও পারে, হতে পারে ব্রাদারহুডেরও অস্তিত্ব রয়েছে! এত গ্রেপ্তার, এত স্বীকারোক্তি, এত মৃত্যুদণ্ডের পর ব্রাদারহুড যে কেবলই একটি জনশ্রুতি নয়, তা নিশ্চিত হওয়া কঠিন। কোনো কোনো দিন এতে তার বিশ্বাস হয়, কোনো দিন হয় না। কোনো প্রমাণ ছিলো না, কেবলই একটি পলায়নপর চোখের চাহুনি, যার কিছু অর্থ থাকতেও পারে; নাও থাকতে পারে। শুনে ফেলা কোনো কথপোকথন, টয়লেটের দেয়ালে লেখা শব্দের অষ্পষ্ট আঁকিবুকি- একদা, এমনকি, যখন দুই আগন্তুকের দেখা হয়, তখনও হাতের ছোট্ট নড়াচড়াই এক ধরনের স্বীকৃতির ইঙ্গিত বহন করে। এসব কিছুই অনুমান। সবই তার কল্পনা। ও’ব্রায়েনের দিকে আর একটি বারের মতোও না তাকিয়ে সে নিজের কক্ষে চলে গেলো। সেই এক লহমার দৃষ্টি বিনিময়ের কোনো ফলোআপ হতে পারে এমনটি তার মনেও আসেনি। মনে যদি সে কথা আসতো তাহলে তা হতো অকল্পনীয় বিপদের কারণ। এক দণ্ড, দু-দণ্ডের জন্য তারা তাদের অস্পষ্ট দৃষ্টি বিনিময় করেছে, আর সে গল্পের সেখানেই সমাপ্তি। যদিও সেটি ছিলো স্মরণযোগ্য ঘটনা, তবে তা স্রেফ রূদ্ধঘরের একাকীত্বেই স্মরণ করা যেতে পারে, আর তার মধ্য দিয়েই মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়।
উইনস্টন মাথা তুললো আর আরও সোজা হয়ে বসলো। পেটের ভিতর থেকে উঠে আসা একটি ঢেঁকুর বের করে দিলো। পাকস্থলী থেকে জিন ততক্ষণে পাক দিয়ে উপরে ঠেলে উঠতে চাইছে।
আবারও চোখ ফেললো কাগজের দিকে। সে দেখলো অসহায় চিন্তুাগ্রস্ততা নিয়ে সে যখন বসেছিলো তখনও সে আসলে লিখেই চলছিলো, যেন স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সম্পন্ন হয়েছে সে কাজ। আর এই লেখা ঠিক আগের মতো ঘিঞ্জি, অসুন্দর হাতের লেখা নয়। তার কলম মনের সুখে মসৃণ পাতায় লিখে গেছে, বড় বড় অক্ষরে সে লেখা-
বিগ ব্রাদার নিপাত যাক
বিগ ব্রাদার নিপাত যাক
বিগ ব্রাদার নিপাত যাক
বিগ ব্রাদার নিপাত যাক
বিগ ব্রাদার নিপাত যাক…
এভাবেই বার বার, পুরো আধা পৃষ্ঠা জুড়ে একই লেখা।
আতঙ্কের বেদনায় মুষড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ রইলোনা উইনস্টনের। যদিও তা ছিলো অযৌক্তিক। কারণ ডায়রি লেখা শুরু করার যে বিপদ, এই কথাগুলো তার চেয়ে বড় বিপদের কারণ হবে; এমনটা নিশ্চয়ই নয়। তবে তারপরেও এক মূহূর্তের জন্য তার মনে হলো পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেলে আর পুরো উদ্যোগটিই বাতিল করে দেয়।
কিন্তু সে তা করলো না, কারণ সে জানতো, অযথাই করা হবে সে কাজ। বিগ ব্রাদার নিপাত যাক লেখা কিংবা এই লেখা থেকে বিরত থাকা এসবের কোনো কিছুই কোনও ভিন্নতা বয়ে আনবে না। ধরা পড়লে থট পুলিশ তার সঙ্গে দুটো কাজের জন্য একই ব্যবহার করবে। আর যদি একটি বারের জন্যও সে কাগজে কলম না ছোঁয়ায়, তাতেও কিছু যায় আসে না। কারণ অপরাধ যা করার সে করে ফেলেছে। একটি বড় অপরাধের মধ্যেই লুক্কায়িত থাকে আর সব অপরাধ। ওরা একে বলে চিন্তাঅপরাধ (থটক্রাইম)। থটক্রাইম চিরদিন ঢেকে রাখা যায় না। আপনি হয়তো সফলভাবে সে অপরাধ কিছু সময়ের জন্য, এমনকি কিছু বছরের জন্য ঢেকে রাখতে পারবেন, কিন্তু আজ নয়তো কাল, এখনই নয়তো আরও পরে তা বেরিয়ে আসবেই।
কাজটি রাতেই ঘটে। গ্রেপ্তার করার জন্য রাতকেই ওরা বেছে নেয়। ঘুমের মধ্যে হঠাৎ একটি ঝাঁকুনি, একটি কর্কশ হাত আপনার কাঁধে, আপনার চোখের ওপর আলো জ্বলছে, বিছানার চারিদিকে ঘিরে রয়েছে কঠিন মুখগুলো। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো বিচার-আচারের বালাই নেই, গ্রেপ্তারের কোনো খবরও নেই। মানুষগুলো ঠিক গুম হয়ে যায়, আর সব সময়ই তা রাতের বেলায়। এরপর আপনার নামটি নিবন্ধনের খাতা থেকে কেটে দেওয়া হবে। আপনি কোথায় কখন কি করেছেন তা সব মুছে ফেলা হবে। আপনি যে কখনো কেউ ছিলেন তাই অস্বীকার করা হবে, এবং এরপর ধীরে ধীরে সবাই সব ভুলে যাবে। আপনি বিলুপ্ত হয়ে যাবেন, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। সাধারনত যে শব্দটি ব্যবহার করা হয় তা হচ্ছে- ‘উবে যাওয়া’।
এক মূহূর্তের জন্য স্নায়ুবৈকল্যে পেয়ে বসলো উইনস্টনকে। সে আবার লেখা শুরু করলো এলোমেলো এবং আরও দ্রুততায়-
ওরা আমাকে গুলি করবে, আমি পরোয়া করি না। ওরা আমার ঘাড়ের পেছনে গুলি করবে, আমি পরোয়া করি না। বিগ ব্রাদার নিপাত যাক। ওরা সবসময়ই যে কাউকে ঘাড়ের পেছনে গুলি করে। কিন্তু তাতে আমি পরোয়া করিনা। বিগ ব্রাদার নিপাত যাক।
ফের চেয়ারে হেলান দিলো, আর কিছুটা লজ্জাবোধ করে আবার কলম নিয়ে ডায়রির ওপর ঝাপিয়ে পড়লো। এবার শুরু হলো আরও তীব্রতায়। ঘরের দরজায় ঠিক তখনই কড়া নাড়ার শব্দ।
এরই মধ্যে! ইঁদুরের মতো চুপ হয়ে বসে থাকলো সে এক অকারণ প্রত্যাশায়, যাই হোক সাড়া না পেয়ে একবার চেষ্টা করে চলে যেতে পারে। কিন্তু না, কড়া নাড়ার শব্দ বেড়েই চলছে। দেরি করার ফল হবে সবচেয়ে খারাপ। তার হৃদযন্ত্র ততক্ষণে দ্রিম দ্রিম দামামা বাজিয়ে চলেছে, কিন্তু চেহারাটি দীর্ঘ অভ্যাসের কারণে সম্ভবত তখনও ভাবলেশহীন। উঠে দাঁড়ালো, আর দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।
দ্বিতীয় অধ্যায়
দরজার নবে হাত দিয়েই উইনস্টনের চোখে পড়লো টেবিলের ওপর ডায়রিটা খোলা। পাতাজুড়ে লেখা আছে, ‘বিগ ব্রাদার নিপাত যাক’। সে লেখা এত বড় বড় অক্ষরে যে রুমের যে কোনো জায়গা থেকে পড়া যাবে। স্রেফ বোকামি বৈ কিছু নয়। তবে এত আতঙ্কের মাঝেও উইনস্টনের মাথায় এলো- এত সাধের নোটবুকটির ক্রিমের মতো মসৃণ পাতায় সদ্য লেখা ভেজা কালি ছেতড়ে যেতে পারে। সেটা উচিত হবে না। অতএব খোলাই থাক।