এটাও সম্ভব, মূহূর্তের মধ্যেই একজনের ওপর যে ঘৃনা; তা অন্য জনের ওপর চেপে বসে। হঠাৎ, যেভাবে ভয়াবহ দুঃস্বপ্নের মাঝেও কেউ তার প্রচণ্ড চেষ্টায় মাথাটিকে বালিশ থেকে সরিয়ে ফেলতে পারে, ঠিক সেভাবেই উইনস্টন তার মনের সব ঘৃনা স্ক্রিনের মুখটি থেকে তার পেছনের কালোকেশী মেয়েটির ওপর ফেলতে সক্ষম হলো। একটি অদ্ভুত ভাবনা তার মনের ভেতর খেলে গেলো। তার মনে হলে একটি রাবারের মোটা লাঠি দিয়ে মেয়েটিকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে যদি পারে; তাকে উলঙ্গ করে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে সাধু সেবাস্টিয়ানের মতো তীরে তীরে জর্জরিত করতে যদি পারে. কিংবা ওকে প্রথমে বিমোহিত করে পরে ঠিক চরম উত্তেজনার মূহূর্তে যদি জিভটা কেটে নিতে পারে। আর অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন উইনস্টন ভালো করেই যেনো বুঝতে পারছে ঠিক কী কারণে সে মেয়েটিকে ঘৃণা করতো। সে তাকে ঘৃণা করতো কারণ সে যুবতী, সুন্দরী আর ক্লিব, কারণ সে তাকে বিছানায় নিতে চাইতো কিন্তু কখনো পারেনি, কারণ তার মিষ্টি কোমল কটিদেশ, যা বাহুদিয়ে জড়িয়ে রাখার মতো, সেখানে শোভা পাইছে ঘৃণিত ওই লাল পরিকর, যা তার কৌমার্যের উদ্ধত ঘোষণা।
রুম জুড়ে ঘৃণা ততক্ষণে চরমে রূপ নিয়েছে। গোল্ডস্টেইনের কণ্ঠকে তখন সত্যিকারেই ভেড়ার ভ্যা ভ্যা ছাড়া কিছু মনে হচ্ছিলো না।
রুম জুড়ে ঘৃণা ততক্ষণে চরমে রূপ নিয়েছে। গোল্ডস্টেইনের কণ্ঠকে তখন সত্যিকারেই ভেড়ার ভ্যা ভ্যা ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছিলো না। আর স্ক্রিনে তার মুখটি হঠাৎ ভেড়ার মুখ হয়েই ভেসে উঠলো। পরমূহূর্তেই সেই মুখ পাল্টে গেলো এক ইউরেশীয় সৈনিকের মুখাবয়বে। বিশালাকায় ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে সে অবয়ব সামনে এগিয়ে আসছে, আর তার হাতের সাব-মেশিনগান ভীষণ গর্জাচ্ছে। মনে হচ্ছিলো যেনো স্ক্রিন থেকেই লাফিয়ে বের হয়ে হামলে পড়বে সেই সৈনিক। দৃশ্যের চিত্রায়ন এতটাই ভয়াবহ ছিলো যে, সামনের সারির দিকে বসা কয়েকজন তাদের মাথা কিছুটা পেছনে হেলিয়েও দিলো। তবে মাথাগুলো ফের নিজের জায়গায় যেতে না যেতে ঠিক সেই মূহূর্তে সকলের মুখে স্বস্তির এক গভীর রেখা এঁকে দিয়ে ভয়াবহ সৈনিক মূর্তিটি উবে গেলো, আর ভেসে উঠলো বিগ ব্রাদারের মুখাবয়ব। কালো চুল, কালো গোঁফ, ক্ষমতার আধার, রহস্যময় এক শান্তির প্রতীক। আর সে ছবি এতটাই বড় যে গোটা স্ক্রিন জুড়ে ছিলো তার উপস্থিতি।
তবে বিগ ব্রাদার যা বলছিলেন তা কারো কানে ঢুকছিলো না। কি আর হবে! উৎসাহব্যাঞ্জক কিছু বক্তব্য। যুদ্ধের ডামাডোলে এধরনের কথাবার্তা খুব শোনা যায়, নেই স্পষ্ট কোনো বার্তা, কিন্তু বলার ধরনে এক ধরনের আস্থার অভিব্যক্তি আছে। এরপর একসময় বিগ ব্রাদারের মুখমণ্ডলটিও ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো। আর স্ক্রিন জুড়ে ভেসে উঠলো তিনটি স্লোগান-
যুদ্ধই শান্তি
স্বাধীনতা দাসত্ব
অজ্ঞতাই শক্তি
তবে বিগ ব্রাদারের মুখটি এরপরেও কয়েক সেকেন্ড ধরে পর্দায় ভাসছে বলেই মনে হচ্ছিলো, কারণ প্রত্যেকের চোখের মনিতে এর যে প্রভাব তা এত দ্রুত মুছে যাবার নয়। ছোট ধূসরকেশী তার সামনের চেয়ারের ওপর ঝুঁকে পড়লো বির বির করে কি যেনো বলতে বলতে। শব্দটি উইনস্টনের কানে এলোও বটে- ‘আমার ত্রাতা!’। আর এ কথা বলে মেয়েটি তার দুবাহু ছুঁড়ে মারলো স্ক্রিনের দিকে। পরক্ষণেই দুই হাতের তালু দিয়ে চোখমুখ ঢেকে নিলো। দেখে মনে হলো- নিশ্চয়ই এখন কোনো প্রার্থনায় রত হয়েছে সে।
এমনই একটা মূহূর্তে গোটা কক্ষে একধরনের গুঞ্জন শুরু হলো। চারিদিক থেকে ছন্দময় ধ্বনি আসতে লাগলো ‘বি-বি!….বি-বি!’ বার বার উচ্চারিত হতে লাগলো সে ধ্বনি। ধীরে ধীরে প্রথম ‘বি’ উচ্চারণের পর একটু থেমে দ্বিতীয় ‘বি’ উচ্চারণ। একটি ভারী গুঞ্জন। কিন্তু আপনি একটু কৌতুহলী হয়ে কান পেতে শুনলে বুঝতে পারবেন এ ধ্বনি আসলে অনেকগুলো খালি পায়ের দুমদুম শব্দ বৈ কিছু নয়। সম্ভবত টানা ত্রিশ সেকেন্ড চললো ওই ‘বি-বি!’। আপনি যখন কোনও আবেগ দ্বারা তাড়িত থাকবেন তখন এমন শব্দ আপনার কানে পৌঁছাবেই না। অংশত এটি বিগ ব্রাদারের প্রাজ্ঞতা আর রাজসিকতার স্তুতি গান, তবে তার চেয়েও বড় কথা এটি আসলে আত্মসংবেশন, ছন্দময় শোরগোলের মধ্যে থেকে সচেতনতার সলিল সমাধি। উইনস্টনের ভেতরটা যেনো আরও শীতল হয়ে আসছিলো। দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচি তার বিভ্রমগুলো কাটাতে পারেনি। তবে অমানবীয় ওই ‘বি-বি!…বি-বি!’ ধ্বনি তার ভেতরটা ভীতিতে ভরে দিলো।
এটা নয় যে সে নিজে অন্যদের সঙ্গে এই গুঞ্জনে অংশ নেয়নি; সেটা না নেওয়া সম্ভবও ছিলো না। আপনার অনভূতিকে গোপণ করা, চেহারায় অভিব্যক্তিতে নিয়ন্ত্রণ, অন্যরা যা করছে তা নিজেও করা এসবই এক সহজাত প্রতিক্রিয়া। তবে এরই মধ্যে কয়েকটি সেকেন্ড পাওয়া গিয়েছিলো যখন তার চোখের অভিব্যক্তি কল্পনায় তাকে প্রতারণা করে যায়। এবং ঠিক সেই মূহূর্তেই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ঘটে- হলফ করে বলতে পারে- নিশ্চিতভাবেই সেটা ঘটেছে।
এক মূহূর্তের জন্য ও’ব্রায়েনের চোখ ধরা পরে উইনস্টনের চোখে। ও’ব্রায়েন তখন উঠে দাঁড়িয়ে। চশমা জোড়া খুলে ফের তা স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় নাকের ডগায় বসাচ্ছিলেন। আর তখনই, ঠিক এক লহমার জন্য তাদের চোখাচোখি হয়। আর সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সময়টুকুতেই উইনস্টন বুঝে ফেলে- হ্যাঁ সে ঠিক বুঝে নেয়- ও‘ব্রায়েনও তাই ভাবছেন যা রয়েছে তার নিজেরও ভাবনা জুড়ে। এক অভ্রান্ত বার্তা দেওয়া-নেওয়া হয়ে যায়। যেনো তাদের দুজনেরও দুটি মন খুলে গেছে, এবং তাদের একজনের ভাবনা চোখের চাহুনির গতিপথে অন্যজনের ভেতর ঢুকে গেছে। ও’ব্রায়েন যেনো তাকে বলে দিলেন, ‘আমি তোমার সাথে আছি। আমি স্পষ্ট করেই জানি কি রয়েছে তোমার ভাবনা জুড়ে। আমি তোমার অপছন্দের কথা জানি, তোমার ঘৃণার কথা জানি, তোমার ক্ষোভের কথা জানি। কিন্তু ভয় পেয়ো না, আমিও তোমার দিকেই আছি!’ এর পরপরই বুদ্ধিমত্তার সেই দীপ্তি নিমেষে মিইয়ে গেলো। আর ও’ব্রায়েনের চেহারা ঠিক অন্যদের চেহারার মতোই হেঁয়ালিপূর্ণ হয়ে উঠলো।