গোল্ডস্টেইনের এই মিথ্যা ফালতু বয়ানের বাস্তবতা নিয়ে কেউ সন্দেহ করতে পারে এই ভাবনা থেকেই পুরো বক্তৃতার সময়জুড়ে টেলিস্ক্রিনে তার পেছনে দেখানো হচ্ছিলো ইউরেশীয় সেনাদের কুচকাওয়াজ। ভাবলেশহীন কঠিন মুখোভঙ্গির এশীয় চেহারার ওই সেনাদের সারি যেনো শেষ হচ্ছিলো না। একেকটি সারি একেরবার টেলিস্ক্রিনের সামনে চলে এসে আবার দ্রুত সরে যায়, সেখানে এসে হাজির হয় একই রকম দেখতে আরেকটি সারি, সেটিও সরে যায়, আরেকটি আসে। গোল্ডস্টেইনের ভ্যা ভ্যা চিৎকারের ব্যাকগ্রাউন্ডে ভেসে আসছিলো সৈনিকদের বুটের ভারি শব্দ।
ঘৃণার তখন ত্রিশ সেকেন্ডও পার হয়নি। এরই মধ্যে কক্ষের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অবিরাম তাদের ক্রোধের প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছেন। একটি আত্মতৃপ্ত ভেড়ামুখো চেহারা টেলিস্ক্রিনে, তার পেছনে ইউরেশীয় সেনাদের ভীতিকর শক্তির প্রদর্শন, আসলেই এক অসহনীয় দৃশ্য। এর পাশাপাশি গোল্ডস্টেইনের দৃষ্টিভঙ্গি আর চিন্তা আরও ভয় ও ক্রোধ ধরিয়ে দেয়। ইদানিং ইউরেশিয়া কিংবা ইস্ট এশিয়ার চেয়েও বড় ঘৃণার পাত্র হয়ে উঠেছেন এই গোল্ডস্টেইন। সাধারণত এই দুটি শক্তির কোনো একটির সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে অপরটির সঙ্গে শান্তির সম্পর্কই বজায় রাখে ওসেনিয়া। কিন্তু অদ্ভুত দিকটি হচ্ছে, যদিও গোল্ডস্টেইন সর্বত্র-সকলের কাছেই ঘৃণিত-অপমানিত, যদিও প্রতিদিন এবং দিনে সহস্রবার, মঞ্চে, টেলিস্ক্রিনে, সংবাদপত্রে, বইয়ে তার তত্ত্বের বিরোধীতা হয়, গুঁড়িয়ে-উড়িয়ে দেওয়া হয়, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ হয়, নোংরা-ফালতু বলে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা হয়- তা সত্ত্বেও তার প্রভাব কখনো কমতে দেখা যায়নি। তার হাতে অপদস্থ হওয়ার জন্য সবসময়ই নতুন বোকামি থেকেই যায়। এমন একটি দিনও পাওয়া যায়নি যেদিন থট পুলিশের হাতে গোল্ডস্টেইনের জন্য কাজ করছে এমন চর কিংবা অন্তর্ঘাতক ধরা পড়েনি। একটি বিশাল ছায়া সেনাদলের অধিনায়ক সে। একটি গোপন ষড়যন্ত্রকারী নেটওয়ার্কের প্রধান, যারা রাষ্ট্রকে বানচাল করে দিতে চায়।
নেটওয়ার্কের একটি নামও রয়েছে- ‘দ্য ব্রাদারহুড’। একটি ভয়ংকর বইয়ের কথাও শোনা যায়, যেটি আসলে উৎপথগামিতার এক সংক্ষিপ্ত সোপান। গোল্ডস্টেইনই এর রচয়িতা। আর অত্যন্ত গোপনীয়তায় সে বই সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বইয়ের কোনো নাম নেই। কেউ বইটির কথা বলতে গেলে, বা আদৌ যদি বলে, তাহলে স্রেফ ‘দ্য বুক’ কথাটিই ব্যবহার করে। কিন্তু এগুলো কেবল গুজব থেকেই জানা। দলের সাধারণ কোনো সদস্যও বাধ্য না হলে এই ‘ব্রাদারহুড’ কিংবা ‘দ্য বুক’ শব্দের ব্যবহার করবে না।
ঘৃণার দ্বিতীয় মিনিটে গোটা হলেই ক্রোধ ছড়িয়ে পড়লো। মানুষগুলো তাদের নিজ নিজ আসন থেকে লাফিয়ে উঠছিলো আর যতজোড়ে সম্ভব চিৎকার করে যাচ্ছিলো, যেনো তারা স্ক্রিনের ভ্যা ভ্যা শব্দ ছাপিয়ে নিজেদের শব্দ উচ্চারণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ছোট ধূসর চুলের মেয়েটি ততক্ষণে গোলাপী রং ধরেছে, দেখা গেলো তার মুখ ঠিক ডাঙায় তোলা মাছের মতো একবার খুলছে একবার বন্ধ হচ্ছে। ও’ব্রায়েনের ভারী মুখও তখন জ্বলে উঠেছে। তিনি চেয়ারে সোজা হয়ে বসেছিলেন। উঁচু বুকের ছাতি কেঁপে কেঁপে স্ফীত হয়ে উঠছিলো, যেনো তিনি সজোরে আসা ঢেউয়ের আঘাত সহ্য করে দাঁড়িয়ে আছেন। উইনস্টনের পেছনের কালোকেশী মেয়েটি ততক্ষণে ‘জঘণ্য! শুয়োর!’ গলা ফাটিয়ে এসব বলে চলেছে। আচমকা একটি ভারি নিউস্পিক অভিধান তুলে নিয়ে সেটি স্ক্রিনের দিকে ছুড়ে মারলো সে। সরাসরি ওটি গিয়ে পড়লো গোল্ডস্টেইনের নাক বরাবর। এবং পড়েই ছিটকে এলো। কিন্তু তাতে বক্তব্যে বাধা পড়লো না। এমন একটা মূহূর্তে উইনস্টন নিজেকেও আবিষ্কার করলো যে সেও অন্যদের সঙ্গে সমানতালে চিৎকার করছে আর পায়ের গোড়ালি দিয়ে নিজের চেয়ারের পাদানিতে সজোরে লাথি মারছে।
দুই মিনিটের এই ঘৃণা কর্মসূচির একটা অদ্ভুত দিক হচ্ছে- কেউ এতে উপস্থিত থাকলেও ঘৃণা ছড়াতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও কেউ কাজটি না করে পারে না। ভয় আর প্রতিহিংসার উদ্যাম উল্লাস, মেরে ফেলার কিংবা নির্যাতনের প্রগাঢ় ইচ্ছা, হাতুড়ি দিয়ে মুখমণ্ডল থেঁতলে দেওয়ার তীব্র বাসনা সবগুলো মানুষের মধ্যে বিদ্যুৎ প্রবাহের মতো বইতে থাকে। তখন তারা এমনকি অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভয়ঙ্কর চিৎকার জুড়ে দেয়। আর প্রত্যেকেই এমন ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে যে তাতে নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আর এই আচরণ একজনের কাছ থেকে অন্যজনের মাঝে আগুনের হলকার মতো ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
কথা এই যে, উইনস্টনের যে ঘৃনার প্রকাশ দেখা গেলো তা কিন্তু আদৌ গোল্ডস্টেইনের বিরুদ্ধে ছিলো না। বরং সে ঘৃণা ছিলো বিগ ব্রাদারের বিরুদ্ধে, দলের বিরুদ্ধে এবং থট পুলিশের বিরুদ্ধে। আর ঠিক এই মূহূর্তে তার হৃদয় একাকীত্বে ভরে গেলো, উদাসভাবে স্ক্রিনের দিকে তাকালো, আর গোল্ডস্টেইনকে মনে হলো মিথ্যার দুনিয়ায় সত্য আর বিচারবুদ্ধির একক অভিভাবক। আর চারিদিকে এত মানুষের মধ্যে সে নিজেই হচ্ছে এর দ্বিতীয় উদাহরণ। গোল্ডস্টেইন যা কিছু বলছেন তার সবটাই যেনো তার কাছে সত্যি মনে হতে লাগলো। তবে পর মূহূর্তেই আবার বিগ ব্রাদারের প্রতি তার গোপন ঘৃনা রূপ নিলো ভালোবাসায়। বিগ ব্রাদারকে তার অকুতোভয় রক্ষক, এশীয়দের বিরুদ্ধে পাথরকঠিন দৃঢ়তায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন অভিভাবক মনে হচ্ছিলো। পক্ষান্তরে গোল্ডস্টেইনকে, তার নির্বাসন, অসহায়ত্ব এবং এমনকি তার সংশয়পূর্ণ অস্তিত্বের পরেও অশুভ জাদুকর বলেই মনে ঠেকলো। মনে হলো- সে যেনো তার কণ্ঠের শক্তি দিয়েই এই সভ্যতার কাঠামোকে ভেঙ্গে দিতে চায়।