অন্য লোকটির নাম ও’ব্রায়েন। ইনার পার্টির একজন সদস্য এবং কিছু পদেও আছেন। তবে সেসব পদের গুরুত্ব এমনই যে উইনস্টন সে সম্পর্কে সামান্যই ধারণা রাখে। পার্টির একজন সদস্য কালো ওভারঅল পরে এসেছে এমন দৃশ্যে মূহূর্তেই চারিদিকে একটা ফিসফিসানির শব্দ বয়ে যায়। ও’ব্রায়েনের দশাসই পেটানো শরীর, মোটা গর্দান, কর্কশ, কৌতুকতা আর বর্বরতার মিশেল চাহুনি। ভয়ঙ্কর দেখতে হলেও তার আচরণে এক ধরনের খুশির ভাব লেপ্টে থাকে। নাকের ওপর চশমাটি ঠিক করার সময় সে এমন একটা কিছু করে যা কৌতুহল সৃষ্টি করে, মজাও দেয়। এর কোনো সংজ্ঞা নেই বটে, তবে তারপরেও কিছুটা সভ্য বলেই তাকে মনে হয়। ভাবভঙ্গিমায়, কেউ তাকে অষ্টাদশ শতাব্দীর আদর্শবানব্যক্তিদের কারো সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেও, দেখতে পারে।
অনেক বছর ধরে অন্তত ডজন খানেকবার ও’ব্রায়েনকে দেখেছে উইনস্টন। লোকটি তার ভাবনায় ভালো করেই স্থান করে নিতো। তার বিশালাকায় লড়াকু বপু আর ভদ্রোচিত আচরণের মধ্যে যে বৈসাদৃশ্য তাতে তাকে নিয়ে এক ধরণের সিদ্ধান্তহীনতা কাজ করে উইনস্টনের মনে। তবে সেটাই যে একমাত্র কারণ তা নয়। তার চেয়েও বড় কারণ হচ্ছে- তার মধ্যে এক ধরনের বিশ্বাস- অথবা সম্ভবত বিশ্বাস নয় এক ধরনের ভাবনা কাজ কাজ করে যে ও’ব্রায়েন যে রাজনৈতিক মতাদর্শে রয়েছেন তা সঠিক নয়। ওর চেহারায় কিছু একটা আকর্ষণ আছে। এও হতে পারে তার চেহারায় যে ভদ্রোচিত ভাবটি লেখা আছে তার জন্য নয়, ওই আকর্ষণ স্রেফ তার বুদ্ধিমত্তার জন্যই। তবে যাই হোক না কেনো সে এমন একটা লোক যাকে একা পাওয়া গেলে এবং টেলিস্ক্রিনকে ফাঁকি দেওয়া গেলে তার সঙ্গে কিছু বাতচিৎ হতেই পারে। উইনস্টন অবশ্য এই অনুমানকে যাচাই করে দেখার সামান্য চেষ্টাও করেনি। যদিও সে চেষ্টা করার সুযোগও খুব ছিলো তা নয়। ঠিক এই মূহূর্তে ও’ব্রায়েন তার হাতঘড়িটির দিকে তাকিয়ে। দেখে নিলেন তখন প্রায় এগারোটা বাজে। হাবভাবে বোঝা গেলো দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচি শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি রেকর্ডস ডিপার্টমেন্টেই থাকছেন।
উইনস্টন যে সারিতে বসে ঠিক সেই সারিতেই কয়েকটি চেয়ার দূরে বসলেন ও’ব্রায়েন। ধূসরকেশী যে মেয়েটি উইনস্টনের পাশের কক্ষ থেকে চেয়ার টেনে সাজাচ্ছিলো সে বসেছে তাদের দু’জনের মাঝখানের একটি চেয়ায়ে আর আর সেই কালোকেশী বসেছে ঠিক তার পেছনে। পরক্ষণেই দৈত্যাকায় মেশিন থেকে হলের শেষ মাথায় বসানো বিশাল টেলিস্ক্রিনের মধ্য দিয়ে একটি কর্কশ ভাঙা কণ্ঠ বাজতে শুরু করলো। একে স্রেফ চ্যাঁচামেচি ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। এতে মেজাজ খিঁচড়ে আপনার দাঁতকপাটি লেগে যাবে আর তা ঘাড়ের কাছের চুলগুলো পর্যন্ত খাড়া হয়ে উঠবে। তবে ঘৃণা কর্মসূচির শুরুটা এরকমই হলো।
অবধারিতভাবেই জনগণের শত্রু ইমানুয়েল গোল্ডস্টেইনের মুখ স্ক্রিনে ভেসে উঠলো। দর্শকদের মধ্যে এখানে সেখানে তখন কেবলই কানাঘুষার শব্দ। ধূসর চুলের মেয়েটি ভয় আর বিরক্তি মিশ্রণে একটি অদ্ভুত অভিব্যক্তি দিলো। পার্টির বিদ্রোহী আর পশ্চাদপসরণকারী হিসেবে পরিচিত এই গোল্ডস্টেইন। আগে দলের প্রধানসারির নেতাই তিনি ছিলেন, অনেকটা বিগ ব্রাদারের সমমাপের, সম পর্যায়ের। পরে প্রতিবিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন, তার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানাও জারি হয়। কিন্তু রহস্যজনকভাবে কিভাবেই যেনো বেঁচে যান, আর নিরুদ্দেশ হয়ে যান। দুই মিনিটের ঘৃণা কর্মসূচি একেক দিন একেকরকম। কিন্তু এমন একটিদিনও পাওয়া যাবে না যেদিন এর প্রধান লক্ষ্যবস্তু গোল্ডস্টেইন নন। তিনি ছিলেন প্রথম ও প্রধান বিদ্রোহী। দলের পবিত্রতার প্রথম বিনষ্টকারী। ধরে নেওয়া হয়, পরবর্তীতে পার্টিতে যত অপরাধ, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা, নাশকতা, বিচ্যুতি যা কিছুই হয়েছে তার সবকিছুই এই গোল্ডস্টেইনের শিক্ষাপ্রসূত। কোথাও কোন অজ্ঞাতস্থানে বসে এখনো তিনি তার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। হতে পারে সমুদ্রের ওপার থেকে, নয়তো বিদেশি কোনও চক্রের ছত্রছায়ায়, এমনকি হতে পারে, ঠিক যে গুজব প্রায়শঃই কানে আসে, এই ওসেনিয়ার ভেতরেই কোনো একটি গুপ্ত আস্তানা থেকে। উইনস্টনের মধ্যচ্ছদা শুকিয়ে আসছিলো। গোল্ডস্টেইনের চেহারাটা যখনই সে দেখে একটা ব্যাথাভরা অনুভূতি বয়ে যায়। কৃশকায় ইহুদি মুখ, মাথায় ঘন সাদা চুল, ছোট ছাগলা দাড়িতে চতুর চেহারা, একটা সহজাত অবজ্ঞার ভাব মুখে মাখা, লম্বা পাতলা নাকের ডগায় বসানো চশমা জোড়ায় এক ধরনের জরাগ্রস্ত বোকাটে ভাবের প্রকাশ। সব মিলিয়ে ভেড়ার মতো দেখতে আর কণ্ঠস্বরও সেই ভেড়ারই মতোন। দলের নীতির বিরুদ্ধে গোল্ডস্টেইন আক্রমনাত্মক ভঙ্গিতে সমানে বিষোদগার করে যাচ্ছিলেন। প্রতিটি বাক্যে এমন অত্যুক্তি ও ন্যয়ভ্রষ্টতা ছিলো যে, ছোট্ট শিশুটি পর্যন্ত তা পরিষ্কার বুঝতে পারে। আর এমন একটা বিশ্বাসযোগ্য ভঙ্গিতে বলে যাচ্ছিলেন যে অপেক্ষাকৃত কম বুদ্ধিসম্পন্নরা সহজেই তার কথাগুলো মেনেও নিতে পারে। বাক্যবাণে বিগ ব্রাদারকে নাজেহাল করে যাচ্ছিলেন গোল্ডস্টেইন। দলের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় তুললেন আর দাবি তুললেন, ইউরেশিয়ার সঙ্গে যেনো এখনই একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান নিশ্চিত করা হয়। তিনি বাক-স্বাধীনতার কথা বললেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বললেন, সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতার কথা বললেন। হিংস্রভাবে চিৎকার করতে করতে তিনি বললেন, বিপ্লব প্রতারিত হয়েছে- কণ্ঠস্বরের দ্রুত ওঠানামার মধ্য দিয়ে বলে চলা এই কথাগুলো দলের বাগ্মিদের বক্তব্যের স্বভাবজাত ধরণটিরই অনুকরণ। যাতে ছিলো নিউস্পিকের শব্দের ব্যবহার। দলের সদস্যরা বাস্তব জীবনে যতটা নিউস্পিকের শব্দ ব্যবহার করেন তার চেয়েও বেশি।