ভীষণ আতঙ্ক নিয়ে, যা কিছু মনোস্থির করছিলো সেগুলো সম্পর্কে ভুল সচেতনতায় এবার আচমকা লেখা শুরু করলো সে। তার ছোট ছোট, অথচ শিশুসুলভ হাতের লেখাগুলো নোটবুকের পাতায় উপর-নিচ করে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। তাতে বাক্যের শুরুতে ক্যাপিটাল লেটার কিংবা বাক্যের শেষে ফুলস্টপ ব্যবহারের বালাই থাকলো না।
৪ঠা এপ্রিল, ১৯৮৪। গত রাতটি ছিলো সিনেমার। সবই যেনো যুদ্ধের ছায়াছবি। সবচেয়ে সেরা ছিলো ভূমধ্যসাগরের কোনো এক স্থানে উদ্বাস্তুবোঝাই একটি জাহাজে বোমা ফেলার দৃশ্যটি। আর দর্শকরা নিশ্চয়ই সবচেয়ে বেশি মজা পেয়েছে ওই দৃশ্যে, যাতে মোটাসোটা একটি লোক অসীম সাগরেই সাঁতরে হয়েছিলো পলায়নপর আর তার পিছু নিয়েছিলো একটি হেলিকপ্টার। প্রথম দেখা গেলো লোকটি শুশুকের মতো ডুবছে আর ভেসে উঠছে। এরপর তাকে দেখা গেলো হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া গুলির ঝাঁকের ঠিক মাঝখানে। তার চারিদিকের পানিতে আছড়ে পড়া গুলির তোড়ে তৈরি গর্তগুলো স্পষ্ট চোখে পড়ছিলো। পরক্ষণেই চারিদিকে পানি গোলাপি হয়ে উঠলো আর তখনই লোকটি ডুবেও গেলো। এতই দ্রুত যে তখনও গুলির তোড়ে সৃষ্ট গর্তগুলো পানিতে ভরে উঠতে পারেনি। আর যখন লোকটি ডুবে যাচ্ছিলো তখন দর্শকরা ছোটাচ্ছিলো হাসির ফল্গুধারা। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিলো কেউ কেউ। একটু পর সবাই দেখলো বোঝাই করা নারী আর শিশু নিয়ে ভাসছে একটি লাইফবোট। বোটের উপর দিয়ে একটি হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে। ওদের মধ্যে, ইহুদিই হবেন, এক মধ্যবয়সী নারীকে দেখা গেলো অনেকটা ঝুঁকে বসে আছেন। কোলে বছর তিনেকের একটি ছেলে। ছোট্ট শিশুটি ভয়ে চিৎকার করছে আর নারীটির বুকের মধ্যে মাথা লুকোচ্ছে। মনে হচ্ছিলো ও যেনো ওখান দিয়েই ভেতরে ঢুকে যেতে চায়। শিশুটিকে জাপটে ধরে ওকে স্বস্তি দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন নারীটি। যদিও তিনি নিজেও তখন ভয়ে নীল হয়ে আছেন। তারপরেও ছেলেটিকে এমনভাবে আগলে ধরেছিলেন যেনো তার বাহুই ওকে বোমার আঘাত থেকে বাঁচাবে। আর ঠিক তখনই হেলিকপ্টার থেকে ২০ কিলো সাইজের একটি বোমা পড়লো ওদের ঠিক মাঝখানে। এক ভয়াবহ ঝলকানি দিয়ে সেটি বিষ্ফোরিত হলো। নৌকাটি চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়ে দেয়াশলাইয়ের কাঠির মতো ছিটকে গেলো চারিদিকে। সবার চোখে পড়লো এক অসাধারণ দৃশ্য! একটি শিশুর হাত ছিটকে উপর থেকে আরও উপরে উঠছে আর হেলিকপ্টারের নাকে লাগানো ক্যামেরায় তা ধরা পড়েছে। দলের বিভিন্ন আসন থেকে দর্শকরা হাসির হল্লা ছুটালো কেবল এক জন নারী ছিলেন ব্যাতিক্রম। ওই কক্ষে প্রোলদের (ওসেনিয়ার কর্মজীবী শ্রেণি) অংশের প্রতিনিধি তিনি। ক্রোধে উত্তেজনায় পা ছুঁড়তে লাগলেন নারীটি। আর চিৎকার করে বলতে লাগলেন, শিশুদের সামনে এগুলো কীসব দেখানো হচ্ছে, শিশুদের সামনে এগুলো দেখানোর অধিকার কারো নেই। পুলিশ ছুটে এসে নারীটিকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে গেলো। অন্যদের অভিব্যক্তিতে মনে হলো না কিছু একটা ঘটেছে। কেউই আসলে একজন প্রোল কি বললো না বললো, তার কি হলো, না হলো তাতে পাত্তা দেয় না। এটা প্রোলদের গতানুগতিক প্রতিক্রিয়া। ওরা কখনোই…
উইনস্টন লেখা থামালো। অংশত এই কারণে যে, ব্যাথায় তার পা টনটন করেছে। বুঝতে পারছে না ঠিক কী তাকে এই আবর্জনার স্রোতে টেনে এনে ফেলেছে।
তবে কৌতুক আর কৌতুহলের বিষয় হলো- সম্পূর্ণ একটা ভিন্ন স্মৃতি তার মনের কোণে স্পষ্ট হয়ে ওঠার কারণেই কাজটিতে সে হাত দিয়েছে। ভাবনাটি তার মনকে ঠেলে ঠেলে এমন একটি স্থানে নিয়ে ঠেকিয়েছে যে সে মনে করছে এগুলো লিখে ফেলা জরুরি। কিন্তু একথা ভাবতে ভাবতেই তার মস্তিষ্ক বলতে লাগলো অন্য কথা। মস্তিষ্ক এখন বলছে- সেই স্মৃতি নয়, বস্তুত অপর একটি ঘটনা এই লিখতে বসার কারণ। যে ঘটনাটি তাকে এই ভর দুপুরে ঘরে ঠেলে পাঠিয়েছে; আর আজই ডায়রি লেখা শুরু করতেও বাধ্য করেছে।
এমন একটি অতি অস্পষ্ট বিষয়কে যদি আদৌ কোনো ঘটনা কিংবা বিষয় বলা চলে তাহলে তা ঘটেছে ওইদিন সকালেই, মন্ত্রণালয়ে।
তখন বেলা এগারোটার কাছাকাছি। সবাই বেশ ব্যস্ত। উইনস্টন যেখানটায় কাজ করে সেই রেকর্ডস ডিপার্টমেন্টে সবাই মিলে বিভিন্ন কক্ষ থেকে চেয়ারগুলো টেনে টেনে হলরুমে বড় টেলিস্ক্রিনের সামনে সারি বেঁধে বসাচ্ছিলো। ‘দুই মিনিটের ঘৃণা’ কর্মসূচির প্রস্তুতি চলছিলো। উইনস্টন মাঝের সারিতে একটি চেয়ারে কেবল বসবে- ঠিক এমনই সময়ে সে কক্ষে দুই জন মানুষের অপ্রত্যাশিত আগমন। এদের উইনস্টন চেনে, আগে দেখেছে, কিন্তু কখনও কথা হয়নি। দুই জনের মধ্যে একজন একটি মেয়ে, যাকে বারান্দায় বিভিন্ন সময় দেখেছে। সে মেয়েটির নাম জানতো না। তবে এটা জানতো, ফিকশন ডিপার্টমেন্টে কাজ করে। মাঝে মধ্যে তার তেলমাখা হাতে নাট-বল্টু লাগানোর যন্ত্র দেখে ধারণা করেছে মেয়েটি কোনো একটি উপন্যাস লেখার মেশিনের কারিগর হতে পারে। মেয়েটির চেহারায় কাঠিন্য স্পষ্ট, বয়স সাতাশ হবে, মোটা ঘন চুল, মেচতা পড়া গাল আর চালচলনে খেলোয়াড়সুলভ ভঙ্গি। ওভারঅলের উপর দিয়ে কোমড়ের কাছে জুনিয়র অ্যান্টি-সেক্স লিগের প্রতীক চিকন লাল পরিকর বারকয়েক পেঁচিয়ে বাধা। একটু শক্ত করেই বেঁধে নেওয়া ফলে ওভারঅলের উপর দিয়েও নিতম্বদেশ বেশ সুডৌল হয়ে ফুটে উঠেছে। ঠিক যে মূহূর্তে উইনস্টন মেয়েটিকে দেখলো তখন থেকেই সে তাকে ঠিক নিতে পারছিলো না। কারণটা অজানা নয়। মেয়েটির আগমনের ভঙ্গিমাটি এমন যেনো এটি কোনো হকি খেলার মাঠ, নয়তো ঠাণ্ডা স্নান ঘর, নয়তো কমিউনিটিকে চাঙ্গা করে তোলার কোনো কর্মসূচি, আর সে যেনো এক সুন্দর মননশীলতার ধ্বজাধারী। বস্তুত প্রায় সকল নারীকেই অপছন্দ উইনস্টনের। বিশেষ করে যারা একটু সুন্দরী তাদেরতো বটেই। তার মতে, সবসময়ই নারীরা, বিশেষ করে যুবতীরা পার্টির সবচেয়ে সংকীর্ণমনা সমর্থক, এরা স্লোগান সর্বস্ব, সুখের মাছি আর অকারণে অযাচিতভাবে যে কোনো ইস্যুতে নাক গলায়। আর এই মেয়েটিকে তার কাছে এদের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক মনে হয়। করিডোরে যেদিন প্রথম অতিক্রমণ ঘটে একে অপরের, সেদিন মেয়েটি তার দিকে আড়চোখে তীব্র দৃষ্টি হানে। উইনস্টনের মনে হয়, চাহুনি দিয়েই মেয়েটি তার ভেতরটা দেখে নিয়েছে, আর এতে অন্তর্গত একটা কালো আতঙ্ক বয়ে যায় তার শরীরময়। ভাবনায় এও এলো যে, মেয়েটি ‘থট পুলিশের’ কারিন্দা হতে পারে। এমনটা সত্য হওয়া খুব অসম্ভব। তারপরেও তার ভেতরে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি কাজ করতে থাকে। আতঙ্কের সাথে এক ধরনের শত্রুতার মনোভাব মিশ্রিত হয়। এরপর থেকে যখনই মেয়েটি তার কাছাকাছি আসে তখনই তার ভেতরে একই মনোভাব কাজ করতে থাকে।