লিভিং রুমে টেলিস্ক্রিন বসানো জায়গাটি কিছুটা অস্বাভাবিক। শেষ দেয়ালে বসালে গোটা রুমই এর আওতায় আসতো, কিন্তু এটি বসানো হয়েছে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ দেয়ালটির ওপর, ঠিক জানালার উল্টোদিকে। এতে একদিকে স্ক্রিনের চোখ এড়িয়ে একটি চোরকুঠুরি তৈরি হয়েছে, আর ঠিক সেখানটিতেই এখন বসে আছে উইনস্টন। হতে পারে ফ্ল্যাটগুলো বানানোর সময় এই অংশটিকে বুক শেল্ফের জন্য ভাবা হয়েছিলো। চোরকুঠুরিতে বসে উইনস্টন তখন টেলিস্ক্রিনের চোখের বাইরে। কোনো শব্দ করলে তা শোনা যাবে কিন্তু যতক্ষণ এখানে বসে থাকবে তাকে দেখা যাবে না। এমনই একটি অবস্থায় ঠিক যে কাজটি করতে সে যাচ্ছে সেটি করার জন্য অংশত কক্ষের ওই ভৌগলিক আকার-প্রকৃতিই তাকে উৎসাহিত করেছে।
অথবা হতে পারে ড্রয়ার টেনে এইমাত্র যে নোটবুকটি বের করে আনলো সেটিই এর কারণ। নোটবুকটি অদ্ভুত রকমের সুন্দর। এর পাতাগুলো মসৃণ ক্রিমের মতো। অনেক দিনের পুরোনো বলে কিছুটা হলদেটে। আর এরকম কাগজতো গত চল্লিশ বছর ধরে তৈরিই হচ্ছে না। উইনস্টন অনুমান করতে পারে, নোটবুকটি চল্লিশ বছরেরও বেশি পুরোনো হবে। শহরের বস্তির মতো একটি এলাকায় পুঁতিগন্ধময় ভাঙারির দোকানের জানালা পথে প্রথম তার চোখে পড়ে নোটবুকটি। দেখেই ওটি পাবার ভীষণ ইচ্ছা হয় উইনস্টনের। দলের সদস্যদের সাধারণ দোকানে যাওয়ায় বারণ আছে। তবে সে যে খুব কড়াকড়িভাবে মানা হয়, তা নয়। বেশ কিছু দ্রব্য-সামগ্রী রয়েছে, যেমন জুতোর ফিতে, রেজর ব্লেড এগুলো ওসব দোকানেই মেলে। রাস্তায় এদিক-ওদিক, মাথাটি ঘুরিয়ে খুব দ্রুত দেখে নিলো উইনস্টন। সুযোগ বুঝে আলগোছে ঢুকে পড়লো দোকানের ভেতরে আর আড়াই ডলার দিয়ে চট করে নোটবুকটি কিনেও ফেললো। ওই সময় উইনস্টনের মাথায় এটি কেনার পেছনে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য কাজ করেনি। অনেকটা অপরাধীর মতোই নোটবুকটি ব্রিফকেসে ঢুকিয়ে বাড়িতে ফেরে সে। এরপর একটি আঁচড়ও এতে কাটা হয়নি। এ যেনো তার অনেক আপস করে পাওয়া এক সম্পত্তি।
এখন উইনস্টন ঠিক যে কাজটি করতে যাচ্ছে তা হচ্ছে- ডায়রি লেখা শুরু করা। কাজটি অবৈধ নয়। (আসলে কোনও কাজই অবৈধ না কারণ আইনই নেই।) তবে এটা সত্য একবার ধরা পড়ে গেলে সাজাটা বেজায় বড়- হয় মৃত্যুদণ্ড, নয়তো শ্রমদাসদের ক্যাম্পে কম করে হলেও ২৫ বছরের বাস। উইনস্টন কলমদানিতে একটি নিব বসিয়ে তাতে চুষুনি টিপে কালি তুলে নিলো। কালির কলম এখন সেকেলে। এর ব্যবহার বলতে গেলে উঠেই গেছে। সই দিতেও এখন কলমের ব্যবহার কদাচই দেখা যায়। উইনস্টন কিন্তু এরই মধ্যে স্রেফ ওই নোটবুকটিতে লেখার জন্যই একটি কলম কিনে ফেলেছে। তার মন বলছিলো, অমন সুন্দর ক্রিমের মতো মসৃণ পাতাগুলোতে আঁচড় কাঁটতে একটি সত্যিকারের নিবের কলমই যথার্থ। ইঙ্ক-পেন্সিল দিয়ে দিয়ে এই অমূল্য পাতায় ঘষাঘষি করার ইচ্ছা তার মোটেই ছিলো না।
হাতে লেখায় অভ্যস্ত ছিলো না উইনস্টন। দুই-একটি ছোটখাটো নোট লেখা ছাড়া আজকাল স্পিক-রাইট পদ্ধতিরই ব্যবহার চলে। তবে ঠিক এই মূহূর্তে সে প্রক্রিয়া কোনো কাজে দেবে না। কলমটি কালির দোয়াতে চুবিয়ে এক সেকেন্ডের জন্য দমে গেলো সে। গোটা শরীরের ভেতরটা একটা ঝাঁকুনি খেলো। কাগজের ওপর দাগ কাঁটা একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বটে। আর এক্ষণে সেই কাজটাই করলো। ছোট ছোট প্যাচের অক্ষরে সে লিখলো-
৪ঠা এপ্রিল ১৯৮৪।
পীঠে হেলান দিয়ে বসলো উইনস্টন। পুরোপুরি অসহায়ত্বের অনুভব ভর করলো তার ওপর। শুরুতো হলো, কিন্তু মোটে নিশ্চিতই হতে পারছিলো না- এটা ১৯৮৪ সাল তো! স্পষ্ট করেই জানে তার বয়স এখন ঊনচল্লিশ। ১৯৪৪ অথবা ১৯৪৫ এর কোনো একটি দিনে তার জন্ম। কিন্তু গত এক বা দুই বছরে একটি বারের জন্যও কোথাও, কখনো কোনও তারিখ তাকে লিখতে হয়নি। এতে যেনো সালটাই ভুলে বসে আছে সে।
এবার নতুন আরেকটি ভাবনা ভর করলো- কার জন্য এই ডায়রি লিখছে সে? ভবিষ্যতের জন্য, অনাগত প্রজন্মের জন্য। নোটবুকের পাতার ওপর লেখা অনিশ্চিত তারিখটির চারিদিকে দৃষ্টি ঘুরপাক খেতে থাকে, আর মাথায় আসে নিউস্পিকের একটি শব্দ ‘ডাবলথিঙ্ক’ (দ্বৈতচিন্তা)। এই প্রথমবারের মতো তার মনে হলো যা সে করতে যাচ্ছে, তা সে বুঝতে পারছে না। ভবিষ্যতের সঙ্গে আপনি কিভাবে যোগাযোগ করবেন? এটি প্রকৃতিগতভাবেই অসম্ভব। ভবিষ্যততো বর্তমানেরই সন্নিবেশ; তা যদি হয়, তাকে কথা শোনানো দায়; আর হতে পারে ভবিষ্যত বর্তমানের চেয়ে ভিন্ন কিছু; তাহলে এই যোগাযোগের প্রচেষ্টাই বৃথা।
কিছুটা সময় কাগজের দিকে বোকার মতো চোখ ফেলে বসে থাকলো। টেলিস্ক্রিনে ততক্ষণে উচ্চস্বরে সামরিক সঙ্গীত বাজতে শুরু করেছে। উইনস্টন বুঝতে পারছিলো না, সে কি নিজেকে ব্যক্ত করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে, নাকি যা কিছু সে লিখতে চেয়েছিলো তা সব ভুলে গেছে। গত কটি সপ্তাহ ধরে ঠিক এই মূহূর্তটির জন্য সে নিজেকে প্রস্তুত করছিলো। আর তার মন থেকে এই কথাটি একবারের মতোও আলাদা হয়নি যে, এজন্য তার আর কিছুই না, কেবল সাহসের প্রয়োজন। মূল লেখার কাজটি খুব যে কঠিন হবে তা নয়। তাকে একটি কাজই করতে হবে- বছরের পর বছর ধরে সারাক্ষণ মাথার ভিতর যা কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে, সেসবই কলমের নিব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কাগজে চালান করে দিতে। কিন্তু এই মুহূর্তে যেনো সবকিছুই উবে গেছে। উপরন্তু পায়ের গোড়ালির উপরের ঘাঁয়ের জায়গাটিতে একটু বাড়াবাড়ি রকমের অসহনীয় চুলকানি অনুভূত হচ্ছে। তবে চুলকানোর সাহস করলো না সে। কারণ যখনই চুলকায় তখনই জায়গাটি ভীষণ জ্বলতে থাকে। টিক টিক করে একেকটি সেকেন্ড বয়ে যাচ্ছে। এ মূহূর্তে সামনে কাগজের শূন্য পাতা ছাড়া যেনো আর কিছুই তার অনুভূতিতে নেই। এমনকি গোড়ালির ওপরের ঘাঁ, টেলিস্ক্রিনের বাজনা আর জিনের মদিরায় সামান্য বুঁদ হয়ে থাকার ভাবটুকুও যেনো হারিয়ে গেছে।