এক্ষণে তার কথাগুলো অনেকটা স্বপ্নময় হয়ে উঠেছে। পরমানন্দ, পাগলাটে একটা উদ্দীপক ভাব লেগেই আছে তার চোখেমুখে। তার কথায় কোনো ছল চাতুরি নেই, ভাবল উইনস্টন, তিনি ভণ্ড নন, যা কিছু বলছেন তার প্রতিটি শব্দেই তিনি বিশ্বাস করেন। এখন যা কিছু তাকে অবদমিত করে রাখছে তা হচ্ছে তার নিজের বুদ্ধিবৃত্তিক অধস্তনতা বোধ। বিশাল ভারী মার্জিত মানুষটি তখনও একবার এদিক, একবার ওদিক করে চলেছেন। একবার তার দৃষ্টিসীমা থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন, আবার ঢুকছেন। সব দিক থেকেই ও’ব্রায়েন তার চেয়ে বড়। অনেক আগেই যা কিছু জেনে, পরীক্ষা করে, বুঝে ও’ব্রায়েন বাতিল করেছেন তা সে কখনো করতে পেরেছে কিংবা পারবে বলেও তার ধারণা হয় না। তার মন ধারণ করে আছে উইনস্টনের মন। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে কী করেই সত্য হয় যে, ও’ব্রায়েন পাগল? আসলে পাগল হচ্ছে সে নিজে, উইনস্টন। ও’ব্রায়েন থামলেন আর নিচে তার দিকে তাকালেন। তার কণ্ঠ আবারও কঠোর হয়ে উঠল।
‘ভেবো না, তুমি নিজে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে, উইনস্টন, বরং নিজেকে আমাদের কাছে পুরোপুরি সমর্পণ করো। ছাইদানীতে যারা নিজেদের নিয়ে গেছে তারা কেউ ছাড় পায়নি। আর আমরা যদি তোমাকে তোমার প্রাকৃতিক জীবনের বাইরের জীবনটিও যাপন করতে দেই, তুমি পার পাবে না। এই এখানে তোমার ক্ষেত্রে যা কিছু ঘটছে তা ঘটেই চলবে। বিষয়টা আগেভাগেই বুঝে নাও। আমরা তোমাকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে ধুলিস্মাৎ করে দেব যেখান থেকে ফিরে আসার আর কোনো পথ নেই। তোমার ক্ষেত্রে এমন সব কিছু ঘটবে যা থেকে তোমার পরিত্রাণের আর কোনো উপায় থাকবে না, তা যদি তুমি হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকো, তাহলেও না। সাধারণ মানুষের অনুভব ফিরে পাওয়ার যোগ্যতাই তোমার থাকবে না। তোমার ভেতরের সবটাই হবে মৃত। তুমি আর কোনোদিনই ভালোবাসতে পারবে না, বন্ধুত্ব করতে পারবে না, জীবনের আনন্দ খুঁজে পাবে না, হাসি-ঠাট্টা, কৌতূহল, সাহস, মর্যাদা কোনোটারই কোনো বোধ তোমার মাঝে জাগ্রত থাকবে না। তুমি হয়ে যাবে স্রেফ ফাঁকা। আমরা তোমাকে শূন্যতায় সংকুচিত করে দেব, এরপর তোমার ভেতরটা আমাদের দিয়ে ভরে দেব।
থামলেন এবং সাদা কোটধারীর দিকে ইঙ্গিত করলেন। উইনস্টন বুঝতে পারছিল তার মাথার পেছন দিকটাতে ভীষণ ভারী কিছু একটা বস্তু ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ও’ব্রায়েন বিছানার পাশে বসে পড়েছেন ফলে তার মুখখানি এখন ঠিক উইনস্টনের মুখের সামনে।
‘তিন হাজার’—উইনস্টনের মাথার উপর দিয়ে সাদা কোটধারীর উদ্দেশ্যে উচ্চারণ তার।
ইষৎ আর্দ্র দুটি নরম প্যাড উইনস্টনের কপালের দুই দিক থেকে নেমে এসে চেপে ধরল। ভয়ে কুঁকড়ে গেল সে। ব্যথা আসছে, নতুন ধরনের এক ব্যথা। ও’ব্রায়েন তার গায়ের ওপর একটি হাত রাখলেন, নিশ্চয়তার হাত, অনেকটাই দয়াশীলতার সে হাত।
‘এবার তুমি ব্যথা পাবে না’—বললেন তিনি। ‘চোখ দুটো আমার চোখে রাখো। ’
এইক্ষণে তার মনে হলো ঘটে গেছে প্রলয়ঙ্কারী এক বিস্ফোরণ, বিস্ফোরণই, তবে নেই কোনো শব্দ। নিঃসন্দেহে চারিদিকে চোখ অন্ধ করে দেওয়ার মতো আলোর ঝলকানি। উইনস্টন আহত নয় তবে ধরাশায়ী। যদিও আগে থেকেই চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, তারপরেও তার মনে হলো বিস্ফোরণের ধাক্কায়ই এমন চিৎপাৎ অবস্থা তার। একটি ব্যথাহীন ভয়াবহ ঘুষিতে সে পুরোই কুপোকাত। এছাড়াও তার মাথার ভেতরেও ঘটে গেছে কিছু একটা। চোখ যখন দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেল তখন বুঝতে পারল কে সে, আর কোথায় সে, চিনে ফেলল তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা মুখটিও। কিন্তু কোথাও বা অন্য কোনোখানে একটি বড় শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, যেন হতে পারে তার মস্তিষ্কের ভেতর থেকে একটি অংশ খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
‘এটাই শেষ নয়’—বললেন ও’ব্রায়েন। ‘আমার চোখের দিকে তাকাও। ওশেনিয়ার যুদ্ধ এখন কোন দেশের সঙ্গে?’
উইনস্টন ভাবল। তার মনে আছে ওশেনিয়া বলতে কী বোঝানো হচ্ছে। সে নিজে ওশেনিয়ার একজন নাগরিক। ইউরেশিয়া ও ইস্টেশিয়ার কথাও তার মনে পড়ল। কিন্তু যুদ্ধ কার সঙ্গে চলছে তা তার জানা নেই। আসলে এখন সে আর জানেই না, যুদ্ধ বলে কিছু একটা আদৌ চলছে।
‘আমার মনে নেই। ’
‘ওশেনিয়ার যুদ্ধ চলছে ইস্টেশিয়ার সঙ্গে। তোমার কি সে কথা এখন মনে পড়ে?’
‘হ্যাঁ। ’
‘বরাবরই ওশেনিয়ার যুদ্ধ ছিল ইস্টেশিয়ার বিরুদ্ধে। তোমার জীবনের শুরু থেকে, পার্টির জন্মের শুরু থেকে, সেই ইতিহাসের শুরু থেকে যুদ্ধ চলছে অবিরাম, বরাবরই একই যুদ্ধ। তোমার কি তা মনে পড়ে?’
‘হ্যাঁ। ’
‘এগার বছর আগে তুমি তিন ব্যক্তিকে নিয়ে এক কাহিনী বানিয়েছিলে যাদের ষড়যন্ত্রের দায়ে ঘৃণ্য-মৃত্যু হয়েছে। তোমার মনে হচ্ছিল তুমি একটি কাগজের টুকরো দেখেছিলে যা প্রমাণ করে ওরা ছিল নির্দোষ। কিন্তু এমন কাগজের কোনো টুকরোর অস্তিত্ব কখনোই ছিল না। ওটা ছিল স্রেফ তোমার মনগড়া, আর পরে সেটাই তোমার বিশ্বাসে পরিণত হয়। তোমার কি এখন মনে পড়ে ঠিক কখন ওই কাগজের টুকরোটি আবিষ্কার করেছিলে। তোমার মনে আছে?
এখন আমি তোমার সামনে আমার হাতের আঙুলগুলো তুলে ধরব। তুমি পাঁচটি আঙুল দেখতে পাবে। মনে থাকবে?’
‘জ্বী। ’
ও’ব্রায়েন তার বাম হাতের আঙুলগুলো তুলে ধরলেন, বুড়ো আঙুলটি গুটিয়ে রাখা।
‘এখানে পাঁচটি আঙুল। তুমি কি পাঁচটি দেখতে পাচ্ছো?’
‘হ্যাঁ। ’