তার কথা শেষ হতেই মলোক নামে শয়তানদের আর এক দণ্ডধারী রাজা উঠে দাঁড়াল। শক্তি ও সমরকৌশলের দিক থেকে অন্যান্য শয়তানদের থেকে সে ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। অবস্থার প্রতিকূলতা এবং হতাশা তাকে করে তুলেছিল আরও ভয়ঙ্কর এবং দুর্বার। সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের সমকক্ষ হয়ে ওঠার উচ্চভিলাষে সে হয়ে উঠেছিল নিভীক। স্বর্গ বা নরকের কোন শাস্তির ভয়াবহতাকেই গ্রাহ্য করত না সে।
মলোক এবার বলতে লাগল, আমি চাই প্রকাশ্য যুদ্ধ। আমরা যখন বসে বসে আলোচনা করছি, কৌশলের কথা চিন্তা করছি তখন আমাদের লক্ষ লক্ষ স্বর্গচ্যুত অনুগামীরা যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে স্বর্গাভিযানের জন্য চূড়ান্ত নির্দেশ পাবার প্রতীক্ষায় স্তব্ধ হয়ে আছে। নরকের এই লজ্জাজনক ঘৃণ্য গহ্বরকেই তারা তাদের বর্তমান আবাসভূমি হিসাবে মেনে নিয়েছে। এটা তাদের আবাসভূমি নয়, কারাগার। অথচ যারা আমাদের উপর অত্যাচার ও অবিচার করেছে তারা আমাদের দীর্ঘসূত্রতার সুযোগ নিয়ে রাজত্ব করছে স্বর্গে। না, কোন শক্তিই আমাদের আবদ্ধ করে রাখতে পারবে না এখানে। এখনি প্রস্তুত হও সকলে। এক নরকাগ্নি ও ক্রোধের প্রচণ্ডতায় মণ্ডিত হয়ে স্বর্গলোকের আকাশচুম্বী সৌধমালাগুলিতে জোর করে প্রবেশ করব আমরা। আমাদের উপর যত অত্যাচার করা হয়েছে সেই সব অত্যাচারকে অস্ত্রে পরিণত করে তুলব আমরা। সেই অস্ত্র দিয়ে আঘাত করব সেই সর্বশক্তিমান অত্যাচারীকে। যুদ্ধের ধ্বনি শুনে সেই অত্যাচারী বেরিয়ে এসেই শুনতে পাবে নারকীয় বর্জ্যের শব্দ, বিদ্যুতের পরিবর্তে শুনতে ও দেখতে পাবে নরকাগ্নি আর বিদ্রোহী দেবদূতদের ক্রোধকুটিল রক্তচক্ষু। বুঝতে পারবে তারই আবিস্কৃত সালফারমিশ্রিত যে অগ্নিদ্বারা আমাদের দগ্ধ করে সেই সালফার আর অগ্নি তার সিংহাসনের মধ্যে মিশে আছে।
কিন্তু স্বর্গারোহণের পথটি বড় দূরতিক্রম্য, বড় কঠিন। সে পথ এত উঁচু এবং খাড়াই যে পাখা মেলে সেখানে উঠে যাওয়া সম্ভব হবে না আমাদের পক্ষে।
এখন ভেবে দেখতে হবে স্বর্গ আর নরকের মধ্যবর্তী স্থানে যে বিস্মৃতির নদী আছে সেই নদী পার হয়ে স্বর্গে উঠে যেতে পারব কি না। ঊর্ধ্বগতিই আমাদের স্বভাবজাত ধর্ম। পতন বা নিম্নগতি আমাদের স্বভাবের বিপরীত। কিছুদিন আগে ভয়ঙ্কর শত্রুরা যখন আমাদের পিছন পিছন তাড়া করে নিয়ে আসছিল এই গভীর নরকগহ্বরে, যখন আমরা ছুটে পালিয়ে এসে রক্ষা পাই তখন আমাদের কি মনে হচ্ছিল? তাহলে আরোহণের কাজটা কি খুব সহজ হবে? এটা কি ভয়ের ব্যাপার নয়? যে আমাদের থেকে অধিকতর শক্তিশালী, আবার তাদের রোষ উৎপাদন করে নিজেদের ধ্বংস টেনে আনা কি উচিত হবে? আবার এই নরকে যদি নতুন করে আরও বেশি পরিমাণে শাস্তি ভোগ করতে হয় তাহলে অনেক বেশি পরিতাপের বিষয়।
তাছাড়া এই ঘৃণ্য নরকপ্রদেশে বাস করাটাই তো সবচেয়ে দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়। এই যে আমরা অনিবার্য অগ্নির জ্বালায় ক্রমাগত দগ্ধ হয়ে আমাদের শত্রুর ক্রোধাবেগকে পরিতৃপ্ত করে চলেছি, এর থেকে দুঃখ বা পরিতাপের কি থাকতে পারে? এর থেকে বেশি শাস্তি মানেই তো একবারে ধ্বংস বা বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া। তা যদি হয় তাহলে আমাদের ভয় কিসের? তার রোষ উৎপাদনে আর ভয় পাই না আমরা। এই রোষ চরমে উঠলে হয় আমাদের ধ্বংস করে দেবে আর তা না হলে বিদ্রোহী আত্মা হিসাবে এই নরকেই রেখে দিতে পারে। কিন্তু এই আত্মা অমর ও অবিনশ্বর হলেও এখানে অন্তহীন যন্ত্রণা সহ্য করে যেতে হবে আমাদের। তথাপি এই যন্ত্রণার মাঝেও আমাদের সর্বশক্তিমান শত্রুর স্বর্গলোক আক্রমণ করার মত উপযুক্ত শক্তি আছে আমাদের। তার সিংহাসন যত দুর্গম স্থানেই থাক না কেন, তাদের ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলে সে সিংহাসন অধিকার করব আর তা না হলে চরম প্রতিশোধ গ্রহণ করব তাদের উপর।
এক কুটিল জাকুটির মধ্যে দিয়ে তার কথা শেষ করল মলোক। সে বলল, প্রতিশোধাত্মক এই যুদ্ধ যত ভয়ঙ্করই হোক, দেবতারা তার থেকে বেশি ভয়ঙ্কর।
এবার অন্য দিক থেকে বিলায়েল নামে একজন উঠে দাঁড়াল। তার সমগ্র দেহাবয়বের মধ্যে ছিল এক মর্যাদা আর মহিমার ভাব। মনে হচ্ছিল সে যেন এক কৃতী মহান পুরুষ। কিন্তু তার ভিতরটা ছিল মিথ্যা আর ফাঁপা। এক কপট মাধুর্যে ভরা তার কণ্ঠনিঃসৃত প্রতিটি কথা সুন্দর এক একটি যুক্তি দিয়ে অন্যায়কে ন্যায় এবং মন্দকে শুভ প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করত। তার যুক্তির অস্ত্র দিয়ে সে প্রতিপক্ষের যে কোন পরিণত যুক্তি ও পরামর্শকে খণ্ডন করার চেষ্টা করত।
তার সব চিন্তা ছিল নিম্নমানের। পাপকর্মে তার ছিল অসাধারণ উৎসাহ ও তৎপরতা, কিন্তু কোন পুণ্যকর্মে বা মহকর্মে সে ছিল একেবারে অলস এবং মন্দগতি। কিন্তু তার কণ্ঠে এমনই মাধুর্য ছিল যে তার কথা সকলেই মন দিয়ে শুনত।
এবার সে বলতে শুরু করল, হে নেতৃগণ, আমিও সরাসরি যুদ্ধের পক্ষে। এক প্রবল ঘৃণার আবেগে আমার চিত্তও পরিপূর্ণ আপনাদের মত। কিন্তু অবিলম্বে যুদ্ধ শুরু করার জন্য যে যুক্তি প্রদর্শিত হয়েছিল, সেই যুক্তি প্ররোচিত করার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে প্রতিনিবৃত্তও কম করেনি। যুদ্ধের সামগ্রিক সাফল্যের সম্ভাবনাকে ম্লান করে দিয়ে এক অশুভ সংশয়ের ছায়া বিস্তার করেছে আমার মনে। যারা শুধু এক ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ বাসনাকে লক্ষ্য করে সমস্ত সমরায়োজনকে সংহত করে এবং মন্ত্রণা ও জল্পনা-কল্পনার জাল বিস্তার করে, যারা শুধু এক হতাশার ভিত্তির উপর তাদের সমস্ত সাহসিকতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হতে বাধ্য।