তবু এই কীর্তিমান স্থপতিও স্বর্গচ্যুত হয়। ক্রুদ্ধ জোভ স্বর্গলোকের প্রান্তবর্তী এক দুর্গপ্রাসাদ হতে এই নরকে নিক্ষেপ করে তাকে। সেদিন গ্রীষ্মকালের কোন এক দিন। সকালে স্বর্গ থেকে নিক্ষিপ্ত হয়ে সূর্য অস্ত যাবার সময় ঈজিয়ান দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত লেমনস দ্বীপে পতিত হয় সে।
কিন্তু যারা একথা বলে তারা ভুল বলে। কারণ সেই স্থপতি এই সব বিদ্রোহী দেবদূতদের সঙ্গেই চিৎ হয়ে পতিত হয় এই নরকপ্রদেশে। যে স্থপতি একদিন স্বর্গে অবস্থানকালে কত প্রাসাদ ও অট্টালিকা নির্মাণ করত সেখানে, আজ সে সেই ধরনের প্রাসাদ ও সৌধমালা নরকে নির্মাণ করার জন্যই পতিত হয়েছে এখানে।
এদিকে দুতেরা রাজার আদেশে শয়তানদের রাজধানী প্যান্ডিমোনিয়ামে রাজপরিষদের ঘোষণা করে বেড়াতে লাগল। প্রতিটি সেনাবাহিনী হতে একজন করে সুযোগ্য প্রতিনিধিকে আহ্বান করল তারা। এইভাবে হাজার হাজার প্রতিনিধি যোগদান করল সে সভায়।
সে সভাস্থলের প্রকাণ্ড প্রবেশপথগুলি জনতার ভিড়ে ভরে গিয়েছিল। সুপ্রশস্ত হলঘরটিতে একেবারেই জায়গা ছিল না। সে ঘরের শুধু মেঝেতে নয়, মাথার উপর শূন্যেও অনেক দেবদূত পাখার উপর ভর করে ঝুলছিল।
বসন্তকালের মৌমাছিরা যেমন সকালবেলায় শিশিরসিক্ত ফুলের উপর ভিড় করে গুঞ্জন করতে থাকে, তেমনি সেই সভাগৃহে সমবেত প্রতিনিধিরা ভিড় করে কলগুঞ্জনে মুখরিত করে তুলেছিল সভাস্থলটিকে। তারা ছিল সংখ্যায় অগণ্য এবং এক স্বল্প পরিসরের মধ্যে অতিশয় ঘনসংবদ্ধ অবস্থায় ছিল।
সে এক আশ্চর্যজনক দৃশ্য। আকৃতিতে আসলে যারা ছিল মর্তমানবদের থেকে : অনেক বড়, তারা পিরামিডের মত নিজেদের দেহগুলিকে মায়াবলে যথাসম্ভব ক্ষুদ্রাকৃতি করে সেই ছোট সভাগৃহটিতে অগণিত সংখ্যায় ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই সব বিদেহী আত্মারা ইচ্ছামত ছোট-বড় করতে পারে নিজেদের দেহকে। তাদের মধ্যে ছিল প্রাচীন রোম ও গ্রীসের বহু অপদেবতা ও শয়তান। তারা স্বর্গআসনে ছিল সমাসীন। ক্ষণকাল নীরবতা পালনের পর সভার কার্যবিবরণী পাঠ করা হলে আলোচনা শুরু হলো।
০২য় সর্গ
দ্বিতীয় সর্গ
আলোচনার শুরুতেই তাদের প্রধান শয়তান স্বর্গের অধিকার পুনরুদ্ধার করার জন্য যুদ্ধের ঝুঁকি নেওয়া হবে কি না সে বিষয়ে এক বিতর্কের অবতারণা করল। উপস্থিত প্রতিনিধিদের কেউ কেউ যুদ্ধের সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করল। আবার কেউ কেউ যুদ্ধ হতে প্রতিনিবৃত্ত থাকার পরামর্শ দান করল। তখন তৃতীয় প্রস্তাব চাওয়া হতে তা উত্থাপিত হলো। শয়তান প্রধানই তার উল্লেখ করে বলল, স্বর্গে থাকাকালে । এর আগে তারা শুনেছিল ঈশ্বর আর এক জগৎ ও আর এক ধরনের মানবজাতি সৃষ্টি করবে। সে মানবজাতি হবে প্রায় দেবতাদেরই সমকক্ষ। এই ধরনের কোন জগৎ আছে কি না আমাদের তা খুঁজে বার করতে হবে। সম্ভব হলে সেখানে আমরা চলে যাব এবং সেই মানবজাতির সাহায্য নেব এই যুদ্ধে।
কিন্তু এই কঠিন অনুসন্ধানকার্যে যেতে কেউই উৎসাহ দেখাল না। তখন শয়তান নিজেই যেতে চাইলে সকলে হর্ষধ্বনি করে অভিনন্দন জানাল তাকে। শয়তান নরকদ্বারের। দিকে এগিয়ে গেলে তখনকার মত সভা ভঙ্গ হলো। এদিকে নরকদ্বারে গিয়ে শয়তান প্রধান দেখল দ্বার রুদ্ধ। কিভাবে সে দ্বার পার হয়ে নতুন জগতের সন্ধানে গেল তারই বর্ণনা আছে এই সর্গে।
রাজকীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে একটি সুউচ্চ সিংহাসনে সমুন্নত অবস্থায় বসেছিল শয়তানরাজ। স্বর্ণ ও মণি-মুক্তামণ্ডিত তার রাজসভার ঐশ্বর্য পারস্যের ওরহমাস, ভারতবর্ষ ও প্রাচ্যের রাজা-মহারাজের ঐশ্বর্যকেও হার মানিয়ে দিয়েছিল। সে তার বুদ্ধিবলে এই অশুভ খ্যাতিসম্পন্ন রাজসম্মানে অধিষ্ঠিত করে নিজেকে। হতাশার গভীর গহুর থেকে সমুচ্চ উচ্চাভিলাষের শিখরদেশে উন্নীত করে সে তার মনকে। স্বর্গের বিরুদ্ধে এক দুর্ধর্ষ সমরাভিযানের জন্য চঞ্চল হয়ে ওঠে সে। অনাগত সাফল্যের এক গর্বোদ্ধত কল্পনায় উদ্দীপিত হয়ে সে বলতে থাকে,
হে শক্তিমান রাজন্যবর্গ ও স্বর্গের অপদেবতাগণ, আমরা উৎপীড়িত ও অধঃপতিত হলেও যেহেতু আমাদের সুসংহত ও অবিনশ্বর শক্তিকে নরকপ্রদেশের কোন গভীরতাই আবদ্ধ করে রাখতে পারবে না চিরতরে, সেইহেতু স্বর্গলোক অধিকারের আশা এখনো ত্যাগ করিনি আমি। এই পতনের শত অপমানকে অগ্রাহ্য করে আমাদের অমর গুণাবলী গৌরবময় ও ভয়াবহ হয়ে উঠবে আরও এবং ভাগ্যের অন্য কোন বিপর্যয়কে ভয় করবে না। যদিও স্বর্গের দেবতাদের বিধানে ন্যায়সঙ্গতভাবে আমি তোমাদের নেতা নির্বাচিত হয়েছি তথাপি আমার বুদ্ধি ও সামরিক শক্তির জন্য তোমরা তোমাদের স্বাধীন ইচ্ছা ও পরামর্শের দ্বারা সর্বসম্মতিক্রমে অবিসম্বাদিত ও নিরাপদ এক রাজকীয় মর্যাদায় এই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করেছ আমাকে। কিন্তু আমি যখন স্বর্গলোকে আরও উন্নত ও সম্মানজনক অবস্থায় অধিষ্ঠিত হব তখন অনেকে আমায় হিংসা করতে পারে। কিন্তু যে সর্বশক্তিমান বস্ত্রধারী জুপিটারের সমকক্ষ এবং তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে তাকে হিংসা করার মত ক্ষমতা কার আছে?
আর এখানেই বা কে আমায় ঈর্ষা করবে? কেই বা যুদ্ধ করবে আমার বিরুদ্ধে? যেখানে পরিণামে ভাল বা লাভজনক কিছু পাবার আশা বা সম্ভাবনা না থাকে সেখানে কখনো যুদ্ধ হতে পারে না। যে নরকপ্রদেশে সকলেই যন্ত্রণায় জর্জরিত, সকলেই যেখানে একই যন্ত্রণায় অংশগ্রহণ করে চলেছে, সেখানে কেউ কখনই বেশি যন্ত্রণা ভোগ করতে চাইবে না। তার ফলে স্বর্গের থেকে এখানে আমরা আরও বেশি করে ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পে দৃঢ় হয়ে আমাদের পুরনো অধিকারের দাবি জানাব। নিশ্চয়ই আমরা আমাদের হারানো সুখসম্পদ পুনরায় লাভ করব। কিন্তু কিভাবে কোন উপায়ে তা সম্ভব হবে, আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করব প্রকাশ্যে অথবা কোন গোপন কৌশল অবলম্বন করে এগিয়ে যাব, সে বিষয়ে এখন আলোচনা করে দেখব। এ বিষয়ে এখন কোন পরামর্শ দেবার থাকলে সে তা বলতে পারে।