অবশেষে সে তাদের কিছু বলার চেষ্টা করল। তারা তা বুঝতে পেরে মাথা নত করে স্তব্ধ হয়ে রইল। তিনবার সে চেষ্টা করল। কিন্তু তিনবারই সে না চাইলেও অবধারিত অবাঞ্ছিত অশ্রুধারায় অবরুদ্ধ হয়ে উঠল তার কণ্ঠ। পরে এক গভীর দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে তার কথা পথ খুঁজে বেরিয়ে এল তার কণ্ঠ থেকে।
সে তার অনুচরদের সম্বোধন করে বলল, হে অমর আত্মাগণ, একমাত্র সর্বশক্তিমান ছাড়া আর কারো সঙ্গে তোমাদের শক্তির তুলনা হয় না। যে যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণামস্বরূপ তোমরা এই ঘৃণ্য ও অবর্ণনীয় দুরবস্থায় পতিত হয়েছ সে যুদ্ধ কিছুমাত্র অগৌরবের নয়। কে তার মনের সমস্ত শক্তি এবং বর্তমান ও অতীত সম্পর্কিত জ্ঞানের গভীরতা দিয়ে বুঝতে পেরেছিল স্বর্গের সম্মিলিত দেবগণ আমাদের প্রতি-আক্রমণের দ্বারা বিব্রত ও বিপন্ন হবে? এই সব অধঃপতিত ও স্বর্গ হতে নির্বাসিত দেবদূতেরা তাদের আদি আবাসভূমি স্বর্গলোক নিজেদের শক্তিতে পুনরুদ্ধার করতে পারবে না, একথা এখন কেউ বিশ্বাস করবে? কে বলবে আমি সব বিপদ অতিক্রম করতে না পেরে সব আশা হারিয়ে ফেলেছি? সে আজ তার রাজশক্তি নিয়ে স্বর্গের সিংহাসনে পূর্ণ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে রাজত্ব করছে। তার শক্তির পরিমাণ সম্বন্ধে আমাদের অজ্ঞতাই বিদ্রোহে প্রলুব্ধ করে আমাদের পতনকে ডেকে আনে।
এখন শুধু আমরা সেই শক্তির ও আমাদের নিজেদের শক্তির পরিমাণ কত তা জানি। এখন শুধু আমাদের প্রয়োজন উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে যাওয়া। এখন সামরিক শক্তি, ছলনা, প্রতারণা প্রভৃতি সব কিছু প্রয়োগ করে সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে পর্যদস্ত করতে হবে। তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে, যারা গায়ের জোরে শত্রুদের জয় করে তারা শুধু অর্ধশক্তিকে জয় করে। সম্পূর্ণরূপে জয় করতে পারে না। স্বর্গ, মর্ত্য ও নরক ছাড়া মহাশূন্যমণ্ডলে আরও অনেক নূতন জগতের সৃষ্টি হতে পারে এবং সেখানে ঈশ্বরের সন্তান মানবজাতির মত এক নূতন জাতির বংশধারার প্রবর্তন করার ইচ্ছা ছিল ঈশ্বরের। আমরা সেই ধরনের কোন জগতে বসতি স্থাপন করব। কারণ আমাদের মত স্বর্গীয় আত্মা বা দেবদূতেরা কখনো নরকগহ্বরের এই অন্ধকারে আবদ্ধ থাকতে পারে না চিরদিন। কিন্তু অনেক চিন্তাভাবনার পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন ভেবে দেখতে হবে, অশান্তি আর হতাশায় মন আমাদের আচ্ছন্ন হয়ে থাকলেও পরাভব বা বশ্যতা স্বীকারের কথা ভাবতেই পারি না আমরা। সুতরাং একমাত্র যুদ্ধ, ঘোষিত বা অঘোষিত যুদ্ধই সমাধান করতে পারে সকল সমস্যার।
এই কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে বলিষ্ঠদেহী সেই সব শয়তানের কটিদেশে আবদ্ধ কোষগুলি থেকে মুক্ত হয়ে অসংখ্য শাণিত তরবারি ঊর্ধ্বে উত্তোলিত হলো। সেই সব তরবারির উজ্জ্বলতায় আলোকিত হয়ে উঠল অন্ধকার নরকপ্রদেশ। তাদের বজ্রমুষ্ঠিগুলি ঢালের সঙ্গে ঘর্ষিত হওয়ায় স্বর্গলোকের বিরুদ্ধে এক প্রকাশ্য বিদ্রোহ বা যুদ্ধের সশব্দ প্রস্তুতি প্রকটিত হয়ে উঠল।
অদুরে একটি পাহাড় ছিল যার শিখরদেশ হতে ক্রমাগত অগ্নি আর ধুম উদগীরিত হচ্ছিল। সেই পর্বতশিখরটি ছিল উজ্জ্বল প্রস্তরের দ্বারা মণ্ডিত। এর থেকে বোঝা যাচ্ছিল সেই পর্বতের গর্ভের মধ্যে ছিল অনেক জ্বলন্ত ধাতু।
অভিযানকারী রাজার সৈন্যদল হতে একটি অগ্রবর্তীবাহিনী যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে আগে গিয়ে শিবির স্থাপন বা পরিখা খনন করে তেমনি বিদ্রোহী দেবদূতরূপী শয়তানদের মধ্যে থেকে একটি দল পাখা মেলে উড়ে গেল সেই পর্বতশিখরে। ম্যামন তাদের নেতৃত্ব দান করল। ম্যামনের দেহটা ছিল কুজ প্রকৃতির এবং তার চোখের দৃষ্টি সব সময় অবনত ছিল। যতদিন সে স্বর্গে ছিল তার অবনত দৃষ্টি নিয়ে সে শুধু রাজপথের ঐশ্বর্যগুলিই দেখতে পেত। কিন্তু স্বর্গলোকের ঊর্ধ্বতন স্তরের কোন পবিত্র বা স্বর্গীয় সুষমা ও সৌন্দর্য দেখতে পেত না সে।
এই ম্যামনের দ্বারা প্ররোচিত হয়েই মানবজাতির অপবিত্র হাতে ধনরত্নের আশায় পৃথিবীর গর্ভদেশ খনন করে বহু স্বর্ণখণ্ড নিয়ে আসে। এই উদ্দেশ্যেই তারা ঐ পর্বতের ধূমায়িত শিখরদেশ বিদীর্ণ করে পৃথিবীর গর্ভে চলে যায় এবং ঐ মুখ নিয়েই বেরিয়ে আসে। তবে নরকের মধ্যে যে ঐশ্বর্য আছে, মাটির গর্ভে যে সম্পদ আছে তার জন্য কেউ যেন মর্ত্যলোকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ না হয়ে ওঠে। কারণ যারা মৰ্তমানবদের সম্পদ ও কৃতিত্বের জন্য বড়াই করে, যারা ব্যাবিলনের বিস্ময়কর স্বর্গোদ্যান ও মিশরের পিরামিডের জন্য গৌরববোধ করে তাদের জানা উচিত, মানুষ এক যুগে অসংখ্য হাতে অবিরাম শ্রমসহকারে যে সব গৌরবময় কীর্তি ও শিল্পকর্ম গড়ে তোলে, বিদেহী আত্মা বা দেবদূতেরা একদিনেই কত সহজেই তা নস্যাৎ করে দেয়। সামনের ঐ প্রান্তরের মধ্যেও অনেক ছিদ্রপথে পৃথিবীর গর্ভ থেকে অগ্নি উদগীরিত হচ্ছে।
অদুরে মাটির ভিতর থেকে যেখানে ঐকতানের মত এক সুরধারা বেরিয়ে আসে, সেইখানে অনেক মূর্তি ও কারুকার্যখচিত এক স্বর্ণমন্দির নির্মিত হয়েছে। সে মন্দিরের ছাদটিও স্বর্ণনির্মিত ছিল। মিশরের অন্তর্গত প্রাচীন কাইরো বা ব্যাবিলনের স্বর্ণযুগেও এই ধরনের অপূর্ব কোন দেবমন্দির নির্মিত হয়নি সেখানে। ও মন্দিরের সৌন্দর্যের কোন তুলনাই হয় না অতীতের কোন মন্দিরের সঙ্গে। এর সুউচ্চ স্তম্ভগুলি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার স্বর্ণনির্মিত ছাদের উপর নক্ষত্রের মত অসংখ্য বাতির আলো জ্বলে। মনে হয় আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে সে আলো। অসংখ্য মানুষ এ মন্দির দেখে এর স্থাপত্যকীর্তি ও স্থপতির প্রশংসা করে। এর স্থপতিই স্বর্গলোকের যত সব প্রাসাদ ও সৌধগুলিকে নির্মাণ করে তোলে নিজের হাতে। লোকে বলে তার নাম নাকি মুনসিবার। প্রাচীন গ্রীসেও তার নাম শোনা যেত এবং সর্বজনবন্দিত ছিল সে নাম।