বিলায়ালের মত এলির পুত্ররাও কামনা আর হিংসার তীব্রতার দ্বারা কলুষিত করে তোলে ঈশ্বরের সৃষ্টিকে। বড় বড় শহরের পথে-ঘাটে তার প্রভুত্ব পরিলক্ষিত হয়। সেই সব শহরগুলিতে মারামারি হানাহানি হাঙ্গামার শব্দ যখন প্রাসাদশীর্ষগুলোতে ছড়িয়ে যায়, অন্ধকার নেমে আসে যখন রাজপথগুলোতে তখন বিলায়ালের পুত্ররা পানোন্মত্ত অবস্থায় দর্পভরে ঘুরে বেড়ায় সেই সব রাজপথে।
সোডম শহরের রাজপথেও এই ধরনের ঘটনা ঘটত। গিবীয়া শহরের রাজপথে কোন এক রাত্রিতে পাননান্মত্ত কয়েকজন ব্যক্তি এক নারীকে বলাৎকার করতে এলে পথের ধারে একটি বাড়ির দরজা খুলে তাকে আশ্রয় দেওয়া হয়। এই বিশৃঙ্খলাজনক ঘটনা প্রায়ই ঘটত তখন।
এরপর যারা এসেছিল তারা হলো গ্রীক দেবতাবৃন্দ যারা ছিল জোফেথপুত্র জানের সন্তান। গ্রীকপুরাণের মতে ইউরেনাস ও গী থেকেই সব দেবতা, দানব ও পৃথিবীর সৃষ্টি হয়। ইউরেনাস-এর ভাই হলো স্যাটার্ন বা শনি এবং তার জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম হলো টিটান। পরে তাদের থেকে শক্তিশালী রীয়ার পুত্র জোভ টিটান ও স্যাটার্নের কাছ থেকে স্বর্গরাজ্যের অধিকার ছিনিয়ে নেয়। পরে প্রথমে ক্রীট ও আইডা এবং পরিশেষে তুষারাচ্ছন্ন অলিম্পাসের সর্বোচ্চ শিখরে রাজত্ব করতে থাকে। এটাই ছিল স্বর্গের রাজধানী। ডেলফির পাহাড়ে এ্যাপোলোর ভবিষ্যদ্বাণী আর উত্তর গ্রীসে অবস্থিত দোদনায় জিয়াসের ভবিষ্যদ্বাণী শোনা যেত। সমগ্র দক্ষিণ গ্রীস, আদ্রিয়া হতে হেসপীরিয়া ও সুদূরবর্তী দ্বীপপুঞ্জগুলিতে এই সব দেবতার প্রভাব প্রসারিত হয়। স্যাটার্ন আদ্রিয়াতিক সাগর অতিক্রম করে ইতালি গিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে নিজেকে।
এরপর দেবদূতরূপী আরও অনেক আত্মা এল। তারা এল বিষণ্ণ মুখে ও অবনত মস্তকে। হতাশার ভারে তাদের অন্তর ভারী হয়ে থাকলেও তারা যখন দেখল তাদের প্রধানের মনে কোন হতাশা নেই, এক দুর্মর অবস্থায় উদ্দীপিত হয়ে আছে তার মনপ্রাণ, তখন আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাদের মুখগুলো। ‘ তারা দেখল তাদের প্রধান পরাজিত হলেও তার মুখে রয়েছে এক অপরাজেয় প্রাণশক্তির রহস্যময় উজ্জ্বলতা। দর্পভরে তার সমস্ত উদ্ধত শক্তিকে সংহত করে বাগাড়ম্বরপূর্ণ ভাষায় সে শক্তির দম্ভকে প্রকাশ করল সে। কিন্তু তাতে তার আসল শক্তির থেকে শক্তির দম্ভটাই প্রকাশিত হলো বেশি। তার এই দম্ভোক্তি তার অধীনস্থ অনুচরদের মন থেকে সব ভয় অপসারিত করে হারানো সাহস ফিরিয়ে আনল তাদের মনে।
এরপর প্রধান জোর গলায় ঘোষণা করল, যুদ্ধের জয়ঢাক আর ভেরী বাজার সঙ্গে সঙ্গে তার জয়পতাকা উত্তোলিত হবে ঊর্ধ্বে। আজাজেল নামে এক শয়তান হবে তার সেনাপতি এবং পতাকাবাহক।
এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পতাকা উত্তোলন করল আজাজেল। স্বর্ণ ও মণি-মুক্তাখচিত এবং বিভিন্ন অস্ত্র ও জয়চিহ্নমণ্ডিত সেই পতাকা ঊর্ধ্বলোকে বিস্তৃত হয়ে উল্কার মত জ্বলজ্বল করতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে নানারকমের ধাতব বাদ্যযন্ত্রে সামরিক বাজনা বাজতে লাগল। শয়তান সেনারা ভয়ঙ্করভাবে এমন জয়ধ্বনি দিতে লাগল যার শব্দে আদিম অন্ধকারে আচ্ছন্ন নরকপ্রদেশ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। মুহর্তমধ্যে বিচিত্র বর্ণের অজস্র পতাকা আন্দোলিত হতে লাগল আকাশে। অসংখ্য বর্শা, শিরস্ত্রাণ এবং ঢাল সঞ্চালিত হতে লাগল ইতস্তত।
এইভাবে রণসাজে সজ্জিত হয়ে উঠল শয়তানেরা। তাদের চোখমুখের উপর সেই সময় ছিল ক্রোধের পরিবর্তে এক বীরত্ববোধ এবং প্রাণপণ সংগ্রামের এক কঠিন সংকল্প। সমস্ত ভয়, সংশয় ও দুশ্চিন্তাকে মন থেকে নিঃশেষে অপসারিত করে ফেলার জন্য তারা যেন ছিল বদ্ধপরিকর।
একই সংকল্পে দৃঢ় ও একই উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেই বিশাল শয়তানবাহিনী বর্শা, ঢাল প্রভৃতি উজ্জ্বল অস্ত্রসম্ভারে প্রাচীনকালের যোদ্ধাদের বেশে সজ্জিত হয়ে সেই অগ্নিদগ্ধ ভূমির উপর দাঁড়িয়ে তাদের প্রধানের কাছ থেকে নির্দেশ পাবার প্রতীক্ষায় স্তব্ধ হয়ে রইল।
তাদের প্রধান তখন তার অভিজ্ঞ ও সন্ধানী দৃষ্টি ইতস্তত পরিচালিত করে সেই শৃঙ্খলাবদ্ধ বাহিনীকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করতে লাগল। দেখল সেই বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি সেনার মুখ এবং চেহারা দেবতাদের মত, তাদের সংখ্যা অগণ্য। তা দেখে এক অপরিসীম গর্বে ভরে উঠল তার বুক। এক সুদৃঢ় শক্তির উচ্ছ্বসিত গৌরব উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠল তার চোখে-মুখে। পৃথিবীতে আসার পর থেকে কোন মানুষ সুসংগঠিত করে দেখেনি কখনো।
এইভাবে দক্ষিণ এশিয়ার লেগ্রায় দৈত্যরা দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। থীবস ও ইলিয়ামে যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয় তাতে দেবতারা উভয় পক্ষে যোগদান করে সাহায্য করে দু পক্ষকে। উথার পুত্র রাজা আর্থারও ইংরেজ নাইটদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে ইতালির ক্যালাব্রিয়া ও এ্যাসপ্রামতে, দামাস্কা বা মরোক্কোতে শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। খ্রিস্টানজীবি শার্লেমেনও সারাসীনদের সঙ্গে যুদ্ধে ফস্তারাব্বিয়াতে তার সেনাপতিগণসহ পরাজিত হয়।
এই সব মর্ত্যমানব বা যোদ্ধাদের সামরিক শক্তির থেকে সেই দেবদূতরূপী শয়তানদের শক্তি ছিল অনেক বেশি। অতুলনীয় সামরিক শক্তিসম্পন্ন সেই সব শয়তানরা রণসাজে সজ্জিত হয়ে তাদের প্রধানের কাছ থেকে চূড়ান্ত আদেশ পাবার জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগল। আকারে ও দর্পিত অঙ্গভঙ্গিমায় তাদের প্রধান ছিল তাদের সবার থেকে শ্রেষ্ঠ। উদ্ধত প্রাসাদশীষের মত দাঁড়িয়ে ছিল সে তাদের মাঝে। অধঃপতিত দেবদূত হলেও তার অঙ্গজ্যোতি তার স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা হারায়নি তখনো। তখনো ম্লান হয়নি তার গৌরব। কুয়াশাচ্ছন্ন দিগন্তে নবোদিত সূর্য অথবা গ্রহণকালে রাহুগ্রস্ত চন্দ্রের মত শুধু স্তিমিত দেখাচ্ছিল তার তেজ। স্তিমিত হলেও তার তেজ অন্য সব অধঃপতিত দেবদূতদের তুলনায় ভাস্বর হয়ে উঠেছিল সবার উপরে। যদিও তার মুখমণ্ডলে বজ্রাঘাতের এক ক্ষতচিহ্ন ছিল পরিস্ফুট এবং তার ম্লান মুখের উপরে বিরাজিত ছিল উদ্বেগের ছায়া, তথাপি এক দর্শনীয় সাহসিকতা প্রকট হয়ে উঠেছিল তার জ্বযুগলের মধ্যে। প্রতিশোধ বাসনায় উদ্ধত হয়ে উঠেছিল এক অনমনীয় দম্ভ। তার দু’চোখের মধ্যে এক দৃঢ় সংকল্পের নিষ্ঠুরতা ফুটে উঠলেও তার অধঃপতিত অনুচরবৃন্দের যন্ত্রণাভোগ দেখে অনুশোচনা ও সমবেদনা জাগছিল তাদের জন্য। একমাত্র শুধু তার অপরাধ ও বিদ্রোহের জন্য অসংখ্য আত্মা তাদের অনন্ত ঐশ্বর্যমণ্ডিত স্বর্গীয় আবাসভূমি থেকে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত হয়ে পতিত হয়েছে এই দুঃসহ নরকপ্রদেশে। আকাশ থেকে ঝরে পড়া জ্বলন্ত রৌদ্রতাপে পত্ৰচ্যুত হয়েও যেমন পর্বতোপরি পাইন গাছগুলি ও অরণ্যমধ্যস্থিত ওক গাছগুলি বিশুষ্ক শাখাপ্রশাখাসহ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে তেমনি হৃতগৌরব হয়েও তার অনুচরেরা তার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে দাঁড়িয়ে ছিল তার কাছে।