জ্বলন্ত জলরাশির উপরে সেই কুলের উপর উঠে দাঁড়াতেই সে তার চিন্তামগ্ন সেই সব সঙ্গীদের ডাকল। তার সেই সব সঙ্গীদের অবস্থা হয়েছিল মিশরের রাজা ফ্যারাওর অত্যাচারে উৎপীড়িত ইহুদীদের মত। ফ্যারাওর সশস্ত্র সৈন্যরা যে মিশরীয় ইহুদীদের তাড়া করে লোহিত সাগরের উপকূলভাগ পর্যন্ত নিয়ে যায় এবং নিরাপদ উপকূলভূমি হতে সমুদ্রের জলে নিমজ্জিত ইহুদীদের ভাসমান মৃতদেহগুলিকে প্রত্যক্ষ করতে থাকে, সেই অসহায় ইহুদীদের মতই তার শয়তান সঙ্গীরাও সেই জলরাশির মধ্যে ডুবে ছিল শুধু তাদের মাথাটি বার করে।
সে তার সঙ্গীদের এত উচ্চকণ্ঠে ডাক দিল যে সেই শব্দে সেই নরকপ্রদেশের গভীরতম কন্দর পর্যন্ত ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠল। তাদের অবস্থার এই ভয়ঙ্কর পরিবর্তনে বিস্ময়াভিভূত তার সঙ্গীরা চমকে উঠল সেই ডাকে।
সে তাদের বলল, হে আমার সহকর্মী যোদ্ধগণ, স্বর্গের যে সুষমা এতদিন ভোগ করে এসেছ তোমরা, আজ সে সুষমা হারিয়েছ। হে অমর আত্মাগণ, তোমরা কি এমনি করে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বসে থাকবে বিকল প্রাণশক্তি নিয়ে? অথবা নিবিড় রণক্লান্তির পর স্বর্গলোকের মনোরম উপত্যকার মত এই স্থানটিকেই নিদ্রা যাবার জন্য বেছে নিয়েছ? অথবা তোমরা কি তোমাদের বিজয়ী শত্রুর বশ্যতা স্বীকার করে নিয়ে তাকে বরণ করে নেবার শপথ করেছ? সেই শত্রু তোমাদের মত অধঃপতিত ও জলমগ্ন বিদ্রোহী দেবদূতের দুরবস্থা আজও পর্যবেক্ষণ করে চলেছে সুদূর স্বর্গলোক হতে। আজও সব শত্রুতা মুছে যায়নি তার মন থেকে। যে কোন মুহূর্তে বজ্রাঘাতে সে তোমাদের গেঁথে দিতে পারে নরকগহ্বরের গভীরতম তলদেশের সঙ্গে। সুতরাং আর ঘুমিয়ে থেক না। জাগো, ওঠ। আর তা যদি না করো তাহলে চিরদিন অধঃপতিত হয়ে থাক এইভাবে।
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ডাকে যেমন তন্দ্রাচ্ছন্ন প্রহরীরা সহসা ব্যস্ত হয়ে জেগে ওঠে, তেমনি প্রধান শয়তানের ডাক শুনে তার দলভুক্ত সকলেই পাখা বিস্তার করে এক লাফে জল থেকে উঠে পড়ল কূলে। এতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের দুরবস্থার গুরুত্বটা বুঝতে পারেনি ঠিকমত, তাদের যন্ত্রণা অনুভব করতে পারেনি। তথাপি তারা তাদের প্রধানের ডাক শুনে প্রস্তুত হয়ে উঠল তার আদেশ পালনের জন্য।
মিশরে থাকাকালে এক ঘোর বিপদের দিনে আসরামপুত্ৰ মোজস সমুদ্রকূলে বেড়াতে বেড়াতে পুবের বাতাসে ভাসমান মেঘমালার মত পঙ্গপালের দলকে আহ্বান করে এবং সেই পঙ্গপালের দল যেমন অধার্মিক ফ্যারাওর রাজ্যের উপর পাখা বিস্তার করে অকালে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দেয় সেই রাজ্যের আকাশ, তেমনি এই সব অশুভ শক্তিসম্পন্ন ঈশ্বরদ্রোহী দেবদূতেরা পাখা বিস্তার করে অন্ধকার করে দিল সেই নরকপ্রদেশের আকাশকে।
তারপর তাদের নেতা বর্শা উত্তোলন করে তাদের পথনির্দেশ করার সঙ্গে সঙ্গে তারা জল থেকে বাইরে উঠে দাঁড়াল শক্ত মাটির উপরে। মধ্যযুগের প্রাক্কালে ইউরোপের উত্তর দিক থেকে আক্রমণ করা বর্বর জাতিদের মতই তারা ছিল অগণ্য। সেই বর্বর জাতির আক্রমণকারীরা উত্তর দিক থেকে রাইন ও ড্যানিয়ুব নদী পার হয়ে বন্যাস্রোতের মত ছুটে এসে জিব্রাল্টার প্রণালী ও লিবিয়ার মরু অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তেমনি সেই বিদ্রোহী দেবদূতেরা তাদের সেনানায়কের নির্দেশে সে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেইখানে এসে অবতরণ করল।
এই সব দেবদূতের দেহাকৃতি ছিল মানুষের থেকে সুন্দর, সুগঠিত ও রাজকীয় মর্যাদাসম্পন্ন। একদিন তাদের প্রত্যেকেই ঈশ্বরের স্বর্গরাজ্যে রাজকীয় সম্মান ও মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু বিদ্রোহ ও চক্রান্তের জন্য স্বর্গ থেকে মুছে যায় তাদের নাম। হারিয়ে ফেলে সব মর্যাদা ও মানসম্মান। আদি-মাতা ঈভের সন্তানদের মত তারা নূতন নামও পায়নি। স্বর্গচ্যুত হয়ে ঈশ্বরের শাস্তিস্বরূপ মানবজাতি যখন মর্ত্যলোকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তখন এই অধঃপতিত ও নামহীন বিদ্রোহী দেবদুতেরা মিথ্যা ছলনার দ্বারা দুর্নীতিপরায়ণ করে তোলে মানবজাতিকে। পরম স্রষ্টা ঈশ্বরকে ত্যাগ করতে বাধ্য করে তারা। ঈশ্বরের বিধানে দেবদূত থেকে বর্বরে পরিণত হয় তারা। অর্থ ও ঐশ্বর্যের মোহে দেবতার পরিবর্তে সেই সব শয়তানদেরই বরণ করে নেয় মানুষ। নাস্তিক মানবজাতির মধ্যে এই সব শয়তানরা বিভিন্ন নামে পূজিত হতে থাকে।
হে কাব্যকলার অদিষ্ঠাত্রী দেবী, বল, কোন কোন নামে অভিহিত হয়ে থাকে তারা। তাদের মধ্যে প্রথম কে এবং কে শেষে তাদের সম্রাটের ডাকে সাড়া দিয়ে সেই অগ্নিময় শূন্য বিশাল প্রান্তরে গিয়ে দাঁড়ায় তার কাছে।
তাদের মধ্যে যারা প্রধান তারা নরকগহুর হতে বেরিয়ে মানব শিকারের উদ্দেশ্যে মর্ত্যলোকে ঘুরে বেড়াতে থাকে। তারা ক্রমে ক্রমে মানবজাতির মধ্যে ঘুরে ঘুরে দেবতার আসনে তাদের অধিষ্ঠিত করে তাদের পূজা করতে বলে মানবজাতিকে। প্রতিটি মন্দিরে তাদের বিগ্রহমূর্তি বেদীতে প্রতিষ্ঠা করে তাদের পূজা করা হতে থাকে। এইভাবে তাদের জঘন্য অভিসন্ধির অন্ধকার দিয়ে ম্লান করে দিতে চায় ঈশ্বরের আলোকে।
মলোক হলো এই ধরনের এক দেবতা যার বিগ্রহ নরবলির রক্তে রঞ্জিত ও অসংখ্য পিতা-মাতার অশ্রুতে সিক্ত হয়ে থাকত সব সময়। কিন্তু অসংখ্য জয়ঢ়াক আর কসরের তুমুল শব্দে বলির শিশু ও তাদের পিতা-মাতাদের কান্না শুনতে পাওয়া যেত না। তারপর সেই নরবলির মাংস আগুনে ঝলসিয়ে ভোগ দেওয়া হত তার বিগ্রহকে।