আমরা যখন অন্য সব কিছু বস্তুই স্বাধীনভাবে উপভোগ করতে পারি, অসংখ্য আনন্দের উপকরণ ইচ্ছামত বেছে নিতে পারি তখন এই একটিমাত্র নিষেধাজ্ঞা মেনে চলা এমন কিছু দুঃসাধ্য কর্ম নয় আমাদের কাছে। আমাদের শুধু একটিমাত্র কর্তব্যকর্ম সাধন করতে হয়। সে কর্ম হলো এই যে, এই সব চারাগাছগুলি অতিরিক্ত বেড়ে গেলে তা হেঁটে দিতে হয় এবং এই ফুলগাছগুলির সেবাযত্ন করতে হয়। এই কাজগুলি করার পর আমরা দুজনে একসঙ্গে ঈশ্বরের গৌরবগান করব। তাছাড়া এ কাজ শ্রমসাধ্য হলেও তোমার সঙ্গে করি বলে মোটেই কষ্ট হয় না।
আদমের কথা শেষ হলে ঈভ তার উত্তরে বলল, যার জন্য আমার এই জীবন সৃষ্ট হয়েছে, যার অঙ্গ থেকে অর্ধাঙ্গিনীরূপে সৃষ্ট হয়েছে আমার দেহ, সেই তুমিই আমার মস্তিষ্ক, তুমিই আমার পথপ্রদর্শক ও পরিচালক! তুমি যা বলেছ তা ঠিক এবং ন্যায়সঙ্গত। ঈশ্বরের কাছে কত বিষয়ে কত ঋণী আমরা। প্রতিদিনই তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়া এবং তার প্রশংসা বা গৌরবগান গাওয়া উচিত।
এদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমার দায়িত্ব আরও বেশি, কারণ আমি তোমার থেকে আরো বেশি সুখ ও সৌভাগ্য ভোগ করি। তোমাকে পেয়ে সব দিক দিয়ে নির্বিঘ্ন ও নিষ্কন্টক হয়ে উঠেছি আমি। অবশ্য তুমি আমার মত সাথী আর কোথাও খুঁজে পাবে না।
সেই দিনটির কথা প্রায়ই মনে পড়ে আমার আজও। সেদিন ঘুম থেকে জেগে উঠেই দেখি একটি গাছের তলায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ফুলের উপর শুয়ে আছি আমি। তখন আমি বিপুল বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবতে লাগলাম, আমি কে এবং কোথায় আছি। সেখান থেকে উঠে আমি কিছুটা এগিয়ে গেলাম। সহসা আমার অদূরে একটি গুহার মুখে জলের কলকল শব্দ শুনে সেদিকে তাকিয়ে দেখি একটি পার্বত্য গুহা থেকে : একটি জলের ধারা সশব্দে বেরিয়ে এসে সমতলের উপর ছড়িয়ে পড়ছে। তারপর সেই জলধারা একটি হ্রদের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকছে। সেই হ্রদের জল স্বচ্ছ নীল– আকাশের মতই এমন স্বচ্ছ ছিল যে তাতে সবকিছু প্রতিবিম্ব দেখা যায়।
কৌতূহলবশত আমি সেই হ্রদের সবুজ তটভূমিতে নিজেকে শায়িত করে হ্রদের নির্মল জলের দিকে তাকালাম। আমার মনে হল হ্রদ নয়, যেন আর এক আকাশ। সহসা সেই স্বচ্ছ জলের ওপরে একটি মূর্তি ঘাড় বেঁকিয়ে আমাকে দেখছে। আমি তাকে দেখে পিছিয়ে গেলে সেও পিছিয়ে গেল। কিন্তু থাকতে না পেরে আমি ফিরে গিয়ে তার দিকে সপ্রেম ও সহানুভূতির দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলাম তার উপর। তাকে একান্তভাবে পাবার জন্য সাধনা করতে লাগলাম। এমন সময় একটি অদৃশ্য কণ্ঠস্বর সতর্ক করে দিল আমায়, হে সুন্দরী, ওখানে যা দেখছ তা তোমারই ছায়া। তোমার সঙ্গেই তা যাওয়া-আসা বা ওঠা-বসা করে। আমাকে অনুসরণ করো। আমি তোমাকে এমন জায়গায় নিয়ে যাব যেখানে তুমি শুধু তোমার ছায়া বা দেহের প্রতিরূপটিকেই দেখবে না, সেখানে তুমি যার প্রতিমূর্তি তাকে তুমি সশরীরে দেখতে পাবে, তাকে তুমি আলিঙ্গন করতে পারবে। চিরদিন তার সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত থেকে উপভোগ করে যেতে পারবে তুমি। তুমি তার বহু সন্তান গর্ভে ধারণ করবে এবং মানবজাতির আদি মাতা হিসাবে অভিহিত হবে।
সেই কণ্ঠস্বর আরও বলল, তুমি আমাকে দেখতে পাবে না। অদৃশ্য অবস্থায় আমি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব তোমাকে। তুমি শুধু নীরবে নির্বিচারে অনুসরণ করে যাবে আমায়।
আমি সেই কণ্ঠস্বরের কথামত তাকে অনুসরণ করে যেতে লাগলাম। তোমাকে দেখতে পেলাম। সুন্দর, দীর্ঘ দেহ। কিন্তু আমার মনে হলো জনবিস্মিত সেই মূর্তির থেকে কম নমনীয়, কম নম্র। আমি তাই পিছন ফিরে চলে যেতে শুরু করলাম। তুমি তখন চিৎকার করে আমায় বললে, ফিরে এস সুন্দরী ঈভ, কার ভয়ে তুমি পালাচ্ছ এমন করে? তুমি জান না, যার কাছ থেকে পালিয়ে যাচ্ছ তুমি তারই অংশ। তোমার দেহাবয়ব গড়ে তোলার জন্য আমি আমার নিজের দেহের অংশ থেকে অস্থি, মজ্জা, ও মাংস দান করি। তুমি আমার অন্তরের নিকটতমা, আমার জীবনের জীবন। তুমি আমার পাশে পাশে সব সময় থাকবে, তুমিই হবে আমার প্রিয়তমা, অন্তরতমা, আমার সকল শান্তি ও সান্ত্বনার উৎসস্থল। তুমি আমার আত্মার অর্ধাংশ, আমার অর্ধাঙ্গিনী। তুমি তোমার শান্ত হাত দিয়ে আমাকে ধরেছিলে। আমি আত্মসমর্পণ করেছিলাম তোমার কাছে। তখন থেকে দেখতে পাচ্ছি, সৌন্দর্য কিভাবে পুরুষোচিত জ্ঞান ও মহিমার দ্বারা পূর্ণতা লাভ করে এবং সেই সৌন্দর্যই প্রকৃত সৌন্দর্য।
এই কথা বললেন আমাদের আদি মাতা। তাঁর চোখে-মুখে ছিল নির্মম দাম্পত্য প্রেমের মদির আকর্ষণ, নীরব আত্মসমর্পণের ভাব। তিনি তখন অর্ধ-আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে আমাদের আদি পিতার উপর হেলে পড়লেন। আলুলায়িত সোনালী কেশপাশে। আচ্ছন্ন তাঁর স্ফীত বক্ষ আদি পিতার বক্ষের উপর স্থাপন করলেন তিনি।
আদি পিতা তখন আদি মাতার দেহসৌন্দর্য ও ননত মাধুর্য দর্শনে বিশেষ প্রীত হয়ে প্রসন্নতার হাসি হাসলেন, ঠিক দেবরাজ জুপিটার যেমন একদিন জুনোর পানে তাকিয়ে হেসেছিলেন এবং পবিত্র চুম্বনের দ্বারা তাঁর ওষ্ঠাধরকে আপীড়িত করেন। জুপিটারের সে হাসিতে মেঘ হতে বসন্ত ফুল ঝরে পড়ে।
তা দেখে শয়তান ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে সরে দাঁড়াল। কঠিন ঈর্ষান্বিত দৃষ্টি দিয়ে নিরীক্ষণ করতে লাগল তাদের। তারপর আপন মনে বলতে লাগল, এ দৃশ্য ঘৃণ্য এবং পীড়াদায়ক। মনোরম স্বর্গোদ্যানে এই দুটি মানব-মানবী পরস্পর আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় এক পরম স্বর্গীয় সুখ উপভোগ করছে, অথচ আমি নরকে নিক্ষিপ্ত। যে নরকে কোন প্রেম নেই, আনন্দ নেই, আছে শুধু অতৃপ্ত কামনার ভয়ঙ্কর পীড়ন, সেই নরকের অন্ধকারে প্রজ্জ্বলিত নরকাগ্নির জ্বালাময়ী উত্তাপের সঙ্গে অতৃপ্ত কামনার বেদনা আর ব্যাকুলতা ভোগ করে যেতে হয় আমাদের।