আমাদের শত্রুদের ক্রোধের প্রচণ্ডতা প্রশমিত হোক না হোক, এই ঘটনাকে উপেক্ষা করলে চলবে না। একবার চেয়ে দেখ, এক শূন্য ঊষর প্রান্তর বিস্তৃত হয়ে আছে। তোমার সামনে। আলোকহীন এই অন্ধকার প্রান্তরের এখানে-সেখানে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড হতে বিচ্ছুরিত শিখাগুলি এক ম্লান ও ভয়ঙ্কর আভা বিকীর্ণ করছে। যদি সম্ভব হয় তো ঐ অগ্নিপ্রবাহের মধ্যেই বিশ্রাম করতে হবে আমাদের। ঐখানেই আমাদের ছত্রভঙ্গ হতোদ্যম সেনানীদের পুনরায় সমবেত ও সংগঠিত করে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে দেখতে হবে কিভাবে শত্রুর উপর আমরা আঘাত হেনে আমাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারি, কিভাবে এই সর্বনাশা বিপর্যয় হতে পরিত্রাণ পেতে পারি এবং আশা থেকে এক প্রাণশক্তি আহরণ করতে পারি। যদি তা না পারি তাহলে ভেবে দেখতে হবে, এই নৈরাশ্যজনক অবস্থা থেকে কি কর্মপন্থা অবলম্বন করতে পারি।
এইভাবে শয়তান প্রবহমান বন্যাস্রোতের মধ্যে পা ডুবিয়ে মাথাটি কোনরকমে তুলে তার নিকটতম সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলতে লাগল। বিরাটাকার জলজ জন্তু অথবা টিটানীয় দৈত্য-দানবদের মত জলের উপর মাথা তুলে ভাসছিল শয়তান বীলজীবাব। ঈশ্বরের বিধানে সে শৃঙ্খলিত অবস্থায় সেই জ্বলন্ত জলরাশির উপর এমনভাবে ভাসছিল যাতে করে তার কু-অভিসন্ধি পূরণ করার প্রচুর অবকাশ ছিল। যাতে করে সে তার অপরাধের পুনরাবৃত্তি করে নতুন করে অভিশাপের বোঝা তুলে নিতে পারে তার মাথায়। সে তখন তার প্রচণ্ড ক্রোধ, প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধ বাসনায় অন্ধ উন্মত্ত হয়ে পরের ক্ষতি ও ধ্বংস সাধনের চেষ্টা করে চলেছিল, তখন সে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি তার এই অশুভ চেষ্টার দ্বারা যে মানুষকে সে ছলনার দ্বারা অন্যায় পথে চালিত করে, সেই মানুষের সামনে অনন্ত মঙ্গল ও করুণার পথ প্রশস্ত হয়ে উঠেছে। সে বুঝতে পারেনি, সে চেষ্টার দ্বারা শুধু তার নিজের ক্ষতি করে চলেছে সে। তাই তার মাথায় পুঞ্জীভূত হয়ে উঠছে শুধু প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধ বাসনা। শুধু তারই জীবনে নেমে আসছে এক জটিল বিশৃঙ্খলা আর কুটিল অশান্তি।
সেই জলরাশির মধ্যে সাঁতার কেটে পায়ের তলায় এক শক্ত মাটি পেল সে। সে তখন তার পাখাদুটি বিস্তার করে শুকনো জমির উপর তার বিশাল দেহটি নিয়ে অবতরণ করল। ধূসর ছায়ান্ধকারে ভরা সেই জমির উপর জ্বলছিল শুকনো আগুন। সেই জলাশয়ে জ্বলতে থাকা আগুনের মত সে আগুন তরল ছিল না। শত শত ধাতব দাহ্য বস্তুর দ্বারা পুষ্ট এটনার মত জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি হতে যেমন ধূম ও অসংখ্য অগ্নিস্ফুলিঙ্গ উদগীরিত হয়ে বাইরের বাতাসকে উত্তপ্ত করে তোলে, তেমনি সেই ধরনের ধূমায়িত অগ্নিতপ্ত বাতাসের দ্বারা পরিপূর্ণ সেই পতিত জমির উপর পদার্পণ করল সে।
বীলজীবাবের পরেই তার সঙ্গীও পদার্পণ করল সেখানে। দুজনেই নিজেদের শক্তিতে মুক্তি পেল সেই জ্বলন্ত জলরাশি থেকে।
তারপর বীলজীবাবের সঙ্গী সেই হৃতগৌরব বিদ্রোহী দেবদূত বলল, চির-আলোকিত অনন্ত সুষমা স্বর্গলোকের পরিবর্তে চির-অন্ধকার ও বিষাদাচ্ছন্ন এই স্থানই কি আবাসভূমি হবে আমাদের? তাই হোক, কারণ সর্বশক্তিমান যা ভাল বুঝবে তাই হবে, তার ইচ্ছাই পরিপূরিত হবে এবং তারই আদেশ পালিত হবে। শুধু শক্তির জোরে যে
সকলের উপর প্রভুত্ব করছে সেই সর্বশক্তিমানের কাছ থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভাল। বিদায়, হে চিরসুখবিরাজিত চির-হাস্যোজ্জ্বল মনোরম ক্ষেত্ররাজি। স্বাগত হে বিভীষিকাময় গভীরতম নরকপ্রদেশ, তোমার এই নূতন অধিকারীকে বরণ করে নাও, স্থান ও কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যার মন পরিবর্তিত হয় না। স্বস্থানে সুপ্রতিষ্ঠিত সেই মনই নরককে স্বর্গে এবং স্বর্গকে নরকে পরিণত করে তোলে। আমি যেখানেই থাকি না কেন, কি আসে যায় তাতে? বজ্রধারী আমার শত্রুর থেকে শক্তিতে যদি আমি কিছু কম হই তাতেই বা ক্ষতি কি? এখানে অন্তত আমরা স্বাধীনভাবে থাকতে পারব। সর্বশক্তিমানের হিংসার জাল বিস্তৃত হবে না এতদূর পর্যন্ত। তার শাসন ও তাড়নের সীমা থেকে মুক্ত এ প্রদেশ। এখানে আমরা নিরাপদে রাজত্ব করতে পারি। আমার মতে রাজত্বই হবে সকল উচ্চাভিলাষের লক্ষ্যবস্তু এবং স্বর্গে দাসত্ব করার থেকে নরকে রাজত্ব করা অনেক ভাল। কিন্তু আমার সঙ্গীরা কি জন্য এখনো পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে এই শক্ত জমির উপর না উঠে সর্ববিস্মরণী ঐ জ্বলন্ত জলাশয়ের মধ্যে দুঃখে কাতর হয়ে শুয়ে আছে? কেন তারা আমাদের ছিন্নভিন্ন শক্তিগুলিকে সমবেত ও সংগঠিত করে হারানো স্বর্গরাজ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। না?
শয়তান এই সব বলার পর বীলজীবাব উত্তর করল, হে সুযোগ্য সেনানায়ক, একমাত্র সর্বশক্তিমান ছাড়া কেউ পরাভূত করতে পারত না তোমাকে। আজ যারা ঐ জ্বলন্ত জলরাশির মধ্যে দুর্দশার শেষপ্রান্তে উপনীত হয়ে ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে পড়ে আছে, তারা যদি তোমার এই তেজোদ্দীপক কণ্ঠস্বর একবার শুনতে পায় তাহলে নূতন সাহস ও উদ্যমে উদ্দীপিত হয়ে উঠবে তারা। আমরাও ওই জ্বলন্ত জলরাশির মধ্যে ছিলাম স্বর্গ থেকে বিচ্যুত হবার পর।
তার কথা শেষ হতেই আর একজন তার থেকে বড় শয়তান জল ভেঙে কূলের দিকে এগিয়ে চলছিল। তার বিশাল গোলাকার ঢালটি তার কাঁধের উপর পূর্ণ চাঁদের মত উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল, যে চাঁদ তুষ্কার শিল্পীরা ফেলোলের গম্বুজ থেকে পর্যবেক্ষণ করে। তার বর্শাটিকে নরওয়ের পাহাড়ে জন্মানো সুউচ্চ পাইন গাছের মত দেখাচ্ছিল যে গাছ থেকে কোন বড় জাহাজের মাস্তুল হতে পারে। জল ভেঙে সমুদ্রপ্রমাণ সে জ্বলন্ত জলরাশির প্রান্তবর্তী কূলে উঠে দাঁড়াল সে, যে কুল ছিল ভলভার্নের পাহাড় নদী সমন্বিত উষর ও বিস্তীর্ণ প্রান্তরের মত দেখতে।