শয়তানরাজ প্রথম থেকে সমানে সঁড়িয়ে এই সব কিছু দেখে যেতে লাগল। বিষাদগ্রস্ত মনে তার স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চারদিকের এই সব দৃশ্যাবলী দেখতে। দেখতে অবশেষে কিছু কথা না বলে থাকতে পারল না।
সে বলল, হে নরক, আমি বিষাদঘন চিত্তে কি সব দেখছি? একদা যা ছিল আমাদের সুখের আবাস সেখানে যারা দেবদূত নয় এমন সব শত শত প্রাণীরা কত সুখে বসবাস করছে। তারা উজ্জ্বলতা বা দিব্য দ্যুতির দিক থেকে কিছুটা নিকৃষ্ট হলেও যে স্রষ্টা তাদের সৃষ্টি করেন সে স্রষ্টার কিছুটা দ্যুতি ও সুষমা ঝরে পড়েছিল তাদের দেহ থেকে। দৈব সাদৃশ্যের একটা অংশ মূর্ত তাদের মধ্যে।
হে প্রেমিকযুগল, তোমরা জান না, তোমাদের এই অবস্থার পরিবর্তন কত নিকটে। অত্যাসন্ন সেই ভাগ্যপরিবর্তনে তোমাদের জীবনের সকল সুখ সকল আনন্দ নিঃশেষে অন্তহিত হয়ে যাবে কোথায় চিরতরে। দুঃখের সীমাহীন গভীরে নিক্ষিপ্ত হবে তোমরা। বর্তমানে যে সুখের যে আনন্দের আস্বাদ লাভ করছ তোমরা, সে দুঃখ হবে এই সুখের থেকে অনেক গুণ বেশি।
তোমরা এখন যে সুখে সুখী সে সুখ তো চিরস্থায়ী নয়। যে স্বর্গলোকের সীমানার মধ্যে বাস করছ তোমরা সে সীমানা তো সুরক্ষিত নয়। যে প্রাচীর দ্বারা এই স্বর্গসীমা বেষ্টিত তা দুর্বল এবং তার প্রতিরক্ষাগত শক্তি এমনই অপ্রচুর ও অসার্থক যে তা আমার মত এক বহিঃশত্রুকে নিবারিত করতে পারল না। অবাধে এ লোকে প্রবেশ করলাম আমি।
কিন্তু স্বর্গের শত্রু হলেও তোমাদের উপর কোন জাতক্রোধ নেই আমার। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমি শত্রু নই তোমাদের। আমি কারো কাছে কোন করুণা বা মমতা না পেলেও আমি এখানে আসি অদৃশ্য অবস্থায়। তোমাদের অলক্ষ্যে অগোচরে তোমাদের করুণামিশ্রিত দৃষ্টিতে না দেখে পারছি না। তোমাদের সঙ্গে মিত্রতাই আমার কাম্য। আমি চাই তোমাদের সঙ্গে এমন এক মিত্ৰতাসূত্রে আবদ্ধ হতে যাতে তোমাদের সঙ্গে মিলেমিশে আমি বাস করতে পারি অথবা তোমরা আমার সঙ্গে বাস করতে পার এখন থেকে।
আমার বাসস্থান হয়ত তোমাদের মনঃপুত না হতে পারে, কারণ তা এই স্বর্গলোকের মত সুন্দর নয়। তবু সেই বাসভূমি সেই পরম স্রষ্টারই এক সৃষ্টি এবং সেই হিসাবে তোমাদের তা মেনে নেওয়া উচিত। তিনিই আমাকে তা দান করেছেন এবং আমি তোমাদের দান করছি।
তোমরা সেখানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নরকপ্রদেশ উন্মুক্ত করে দেবে তার বিস্তৃত দ্বারপথ। সেখানকার রাজারা এগিয়ে আসবে তোমাদের অভ্যর্থনা করতে। সেই নরকপ্রদেশই আমার বাসভূমি। কিন্তু সে স্থান এখানকার মত সংকীর্ণ নয়। তোমার অসংখ্য সন্তানদের স্থানসংকুলানের কোন অভাব হবে না। তারা অনায়াসে বাস করতে পারবে সেখানে।
সে স্থান যদি তোমাদের ভাল না লাগে তাহলে কোন উপায় নেই। তাহলে তোমরা আমার প্রতি কোন অন্যায় না করলেও যিনি আমার উপর অন্যায় করেছেন, যিনি আমাকে তোমাদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের পথে টেনে নিয়েছেন তাকে ধন্যবাদ দিও। যদিও তোমাদের নিস্পৃহতা ও নির্দোষিতায় আমি বিগলিত হয়ে পড়ছি, তথাপি সাধারণের স্বার্থ ও সম্মানের খাতিরে রাজ্যলাভের আকাঙ্ক্ষায় আমি এই নতুন জগৎ অধিকার করে আমার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে চাই আর তার জন্যই আমি বাধ্য হয়ে এমন এক জঘন্য কাজ করতে এসেছি যা আমি নিজেই ঘৃণা করি।
এই সব কথাগুলি আপন মনে বলল শয়তান। সকল অত্যাচারীই তাদের অন্যায় কর্মের স্বপক্ষে যে যে যুক্তি দেখায়, যে প্রয়োজনীয়তার কথার উল্লেখ করে শয়তানও তা করল। তারপর সে যে গাছের উপর একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখছিল সেই গাছ হতে নীচে অবতরণ করে এক চতুষ্পদ জন্তুর রূপ ধারণ করে সেই সব জন্তুদের মাঝে মিশে গেল। কারণ এখান থেকে এইভাবেই তার শিকারের বস্তুর উপর লক্ষ্য রাখা সম্ভব হবে। এখান থেকে তাদের কথাবার্তা বা কাজকর্ম দেখতে পাবে। কখনো বাঘ বা কখনো সিংহ হয়ে সে অগ্নিদৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে সামনে।
মাঝে মাঝে তার দৃষ্টিটাকে এদিকে সেদিকে স্থানান্তরিত করতে লাগল শয়তান। তার মনে হতে লাগল যে কোন মুহূর্তে এই দুটি শিকারকে দুটি থাবার মধ্যে ধরে ফেলতে পারবে।
এরপর দেখা গেল আদি মানব আদম আদি মানবী ঈভকে কি বলতে লাগল আর শয়তান তা শুনতে লাগল কান খাড়া করে।
আদম ঈভকে বলতে লাগল, হে আমার সকল আনন্দের অংশীদার, যে শক্তি আমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং যে বিস্তৃত জগতে আমরা বাস করছি সেই শক্তি ও জগৎ যেন চিরমঙ্গলময় হয় আমাদের পক্ষে। পরম মঙ্গলময় ঈশ্বর আমাদের প্রতি। অপার করুণাবশত আমাদের পথের ধূলি থেকে তুলে এনে এই সর্বসুখকর স্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি আপন ইচ্ছা বা প্রয়োজনমত সব কিছুই সৃষ্টি করতে পারেন।
সেই ঈশ্বর আমাদের জন্য এত কিছু করলেও তিনি আমাদের কোন সেবাই চান না। তিনি আমাদের কাছে চান শুধু একটিমাত্র আনুগত্য। এই বিশাল বিস্তীর্ণ উদ্যানে যত সব উপাদেয় সুস্বাদু ফলের গাছ আছে তার মধ্যে শুধু জ্ঞানবৃক্ষের ফল যেন কখনো আমরা ভক্ষণ না করি। জীবনবৃক্ষের পাশে রোপিত জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেলে তা মৃত্যুসম হয়ে উঠবে আমাদের পক্ষে।
বুদ্ধিমান ঈশ্বর নিজে ঘোষণা করেছেন এই জ্ঞানবৃক্ষের ফলভক্ষণ আমাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠবে। এই জগৎ ও জগতের জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে যত জীব বাস করে সেই সব জীবের উপর প্রভুত্ব ও শাসনক্ষমতা আমাদের দান করে তার বিনিময়ে শুধু এই আনুগত্যই চান। সুতরাং এই নিষেধাজ্ঞাটি যেন খুব আমরা কঠিন না ভাবি।