শয়তানরাজ দেখল তার নীচে স্বর্গোদ্যান আর সবুজ ঐশ্বর্যে পূর্বদিক প্রসারিত। পুর্বে ইভেন নগরীকে বলা হত তেনাসার। এ শহরে আছে গ্রীসের রাজাদের দ্বারা নির্মিত বিরাট এক রাজপ্রাসাদ। পরে ঈশ্বর এইখানে এক উর্বর বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড বেছে নিয়ে তার উপর গড়ে তোলেন এক মনোরম উদ্যান। সে উদ্যানে রোপণ করেন বিভিন্ন জাতীয় বড় বড় গাছ। সেই সব গাছের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু হচ্ছে জীবনবৃক্ষ। সে বৃক্ষে সোনার অমৃত ফল ফলত।
এই জীবনবৃক্ষের পাশেই ছিল. জ্ঞানবৃক্ষ। মানুষের এই জ্ঞানবৃক্ষই মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় একদিন। এই উদ্যানের দক্ষিণ দিকে একটি বড় নদী বয়ে গেছে। সে নদীর সামনে কতকগুলি পাহাড় তার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে থাকলেও নদী তার গতি পরিবর্তন করেনি। সে সেই পাহাড়গুলির তলদেশ ভেদ করে প্রবাহিত হয়েছে।
অনুন্নত যে পাহাড়টিকে ভিত্তি করে স্বর্গের উদ্যানটি রচিত হয়েছে সেই পাহাড়ের উপর আছে একটি স্বচ্ছসলিলা ঝর্ণা যার জলধারা উদ্যানটিকে বিধৌত করে খাড়াই পাহাড়ের গা বেয়ে নীচে পড়েছে। তারপর চারটি শ্রোতোধারায় বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন দিকে বিধৌত করে বিভিন্ন দিকে চলে গেছে।
স্বর্গোদ্যানের বিশাল সীমানার মধ্যে তৃণাচ্ছন্ন উপত্যকার উপর মেষপাল চড়ছিল। মুক্তোর মত স্বচ্ছ জলের ঝর্ণার ধারে ছিল কত ফুল ও ফলের গাছ। সেই উদ্যানের মনোরম দৃশ্যাবলী দেখতে লাগল শয়তানরাজ। তার নিজের মনে কোন আনন্দ না থাকলেও আনন্দময় পরিবেশ দেখতে দেখতে অভিভূত হয়ে গেল সে।
এমন সময় সেই উদ্যানের এক জায়গায় দুটি দেবোপম নগ্ন দানবমূর্তি দেখতে পেল শয়তানরাজ। ঈশ্বরের অনুগৃহীত সৃষ্টি হিসাবে তাদের দেহাবয়বদুটি স্রষ্টার গৌরবকে যেন ঘোষণা করছিল নীরব ভাষায়। তাদের আয়ত চোখের প্রশস্ত উজ্জ্বল দৃষ্টির মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছিল ঐশ্বরিক দ্যুতি। সত্য, প্রজ্ঞা, কঠোর শুচিতা ও পবিত্রতার মূর্ত প্রতীক ছিল যেন তারা। কিন্তু শুচিতার কঠোরতা সত্ত্বেও তাদের মধ্যে ছিল সন্তানসুলভ স্বাধীনতা। তারা যেন ছিল নিজেরাই নিজেদের প্রভু।
জাতি হিসাবে মৃর্তিদুটি মানব হলেও আকৃতি ও প্রকৃতির দিক থেকে তারা সমান ছিল না। প্রকৃতির দিক থেকে একটি মূর্তির মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছিল সাহসিকতা এবং তেজস্বিতা। আর একজনের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছিল মেদুরতা, নম্রতা, কমনীয়তা এবং মোহপ্রসারী সৌন্দর্যের সুষমা।
একটি মূর্তি ছিল আকারে কিছু বড় এবং তার সম্মুখভাগ ও প্রশান্ত উজ্জ্বল চক্ষুদুটিতে ছিল পূর্ণ প্রভুত্বের ছাপ। তার ঘনকৃষ্ণ কেশপাশ তার স্কন্ধদেশ পর্যন্ত ছিল লম্বিত। কিন্তু আর একজনের কুঞ্চিত কেশপাশ ছিল তার ক্ষীণ কটিদেশ পর্যন্ত লম্বিত ও আলুলায়িত। তার মধ্যে ছিল এক সলজ্জ অধীনতা, বিনম্র অহংবোধ। তাকে মনে হচ্ছিল সে যেন কারো অধীন, কিন্তু সে কোন কঠোর শাসন বা রূঢ় প্রভুত্বের বস্তু নয়। তাকে মৃদু অনুশাসনের দ্বারা পরিচালিত করতে হবে।
তার মধ্যে কতকগুলি রহস্যময় দিক ছিল যেগুলি অসংবৃত অবস্থাতেই দেখা যাচ্ছিল। সে ছিল প্রকৃতির সৃষ্টি, যেন প্রকৃতির জীবন্ত কারুকর্ম। তার মধ্যে ছিল যেন এক পাপজনিত লজ্জাবোধ আর অসম্মানজনক সম্মানবোধ।
এই মূর্তিটিই হলো নারীমূর্তি, মানবজাতির আদিমাতা।
হে নারী, তোমার আপাত পবিত্র কপট ভাবের দ্বারা কিভাবে তুমি বিব্রত করে তোল পুরুষদের, কিভাবে তুমি মানুষের জীবন থেকে সব দুঃখ, নীরবতা ও নিষ্কলঙ্ক নির্দোষিতাকে নির্বাসিত করে দিয়েছ চিরতরে?
সেই আদি মানব ও মানবীর মূর্তিদুটি নগ্ন অবস্থায় হাত ধরাধরি করে ধীরে ধীরে গাছে ঘেরা একটি ঝর্ণার ধারে ঈশ্বর ও দেবদূতদের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল। তাদের মনে কোন কুচিন্তা বা পাপবোধ ছিল না। সেই থেকে পৃথিবীতে যত আলিঙ্গনাবদ্ধ প্রেমিকযুগল দেখা গেছে তারা ছিল তাদের সবার থেকে সুন্দর।
আদিপিতা আদম ছিল পরবর্তী কালের সমস্ত মানব সন্তানদের থেকে সুন্দর পুরুষ আর আদিমাতা ঈভ ছিল তার সব কন্যাদের চেয়ে সুন্দরী। ঝর্ণার ধারে এক খণ্ড সবুজ তৃণভূমির উপর তারা দুজনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বলতে লাগল। শুধু উদ্যানের কিছু কাজ ছাড়া অন্য কোন শ্রমের কাজ তাদের করতে হত না।
বনের ফল আর ঝর্ণার জল খেয়ে ক্ষুধাতৃষ্ণা নিবারণ করত তারা। ক্ষুধা পেলে রসাল ফলের ভারে আনত গাছের শাখাগুলি থেকে ফল পেড়ে খেত তারা। তৃষ্ণা পেলে কানায় কানায় ভরা নদী-ঝর্ণার উপর পাশ থেকে ঝুঁকে জলপান করত। এক এক সময় তারা রসাল কচিকচি ভঁটা চিবোত। বিবাহিত যুবক-যুবতীর মত তারা নির্জনে যৌবনসুলভ নেশায় মত্ত হয়ে উঠত মাঝে মাঝে। তাদের মুখের উপর ফুটে উঠত প্রেমমদির হাসি। তাদের চারপাশে বনের পশুরা এমন কি বাঘ, সিংহ, চিতা, ভল্লুক প্রভৃতি হিংস্র জন্তুরাও তাদের সকল হিংস্রতা ভুলে গিয়ে শান্তভাবে সেবা করত তাদের। হাতিরা তাদের শুড় ঘুরিয়ে আনন্দদান করত। সাপেরাও তৃণশয্যার উপর শান্তভাবে শুয়ে ছিল, তাদের অনেক ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
ক্রমে অস্তগমননান্মুখ সূর্য আকাশ থেকে ধীরে ধীরে নেমে এসে পশ্চিমের সমুদ্রের দ্বীপাবলীর উপর ঢলে পড়ল। নক্ষত্রেরা ধীরে ধীরে উদিত হতে লাগল সান্ধ্য আকাশে।