হে সূর্য, তোমার সে আলোকমালা আমার অতীতকে স্মৃতিপথে জাগ্রত করে তুলছে। সেই আলোকমালাকে আমি কত ঘৃণা করি। অতীতে একদিন আমি কি গৌরবময় আসনেই না অধিষ্ঠিত ছিলাম এবং অহঙ্কার ও ভ্রান্ত উচ্চাভিলাষের বশবর্তী হয়ে আমি স্বর্গরাজ্যের অতুলনীয় অধীশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়ে সেই গৌরবের আসন হতে বিচ্যুত হয়ে সুদুর নরকপ্রদেশে কিভাবে নিক্ষিপ্ত হই–আজ এই সব কথা মনে পড়ছে আমার। সেই স্মৃতির জ্বালাময়ী পীড়নে অনুক্ষণ আপীড়িত হচ্ছি আমি।
আমার পক্ষ থেকে এই ধরনের প্রতিদানে কোনরূপে যোগ্য ছিলেন না তিনি। তিনিই আমাকে সৃষ্টি করে খ্যাতির সুউচ্চ সু-উজ্জ্বল শিখরদেশে প্রতিষ্ঠিত করেন আমাকে। তিনি আসলে কোন ভর্ৎসনা বা কোনরূপ দুর্ব্যবহার করেননি আমার সঙ্গে। তার শাসন এমন কিছু কঠোর বা দুঃসহ ছিল না কারো পক্ষে, বরং তা প্রশংসা ও ধন্যবাদেরই যোগ্য ছিল সর্বাংশে।
কিন্তু হায়, তার সকল মঙ্গলময় কার্য মন্দ মনে হয় আমার এবং আমার মধ্যে জাগায় শুধু হিংসা আর বিদ্বেষ। বস্তুত তিনি আমাকে এত উচ্চে স্থান দেন যে . আমি তার প্রতি কোন বশ্যতা বা আনুগত্যকে ঘৃণার চোখে দেখতে থাকি। ভাবি আর এক ধাপ উপরে উঠলেই আমি সম্মান ও গৌরবের উচ্চতম স্তরে উন্নীত হব। এইভাবে তার প্রতি আমার অন্তহীন কৃতজ্ঞতার প্রভূত ঋণের কথা ভুলে যাই আমি। সে কৃতজ্ঞতার ঋণ দুঃসহ বোঝাভার বলে মনে হয়। কিন্তু ভুলে যাই কৃতজ্ঞতার ঋণ এমনই এক ঋণ যে সে ঋণের স্বীকৃতি উপকারীর সব উপকারের ঋণ পরিশোধ করে দেয়। কিন্তু আমি তখন সে ঋণ স্বীকার না করে সম্পূর্ণরূপে ভুলে গিয়েছিলাম, তার কাছে আমি কত কি পেয়েছি। তার কাছে কত দিক দিয়ে উপকৃত আমি।
হায়! তখন তার অমোঘ বিধানে যদি আমি কোন হীনতর দেবদূত হয়ে জন্মাতাম, তাহলে আমি হয়ত সুখে স্বর্গসুখ ভোগ করতাম আজও। তাহলে অসংযত উদ্দাম আমার ছলনা এমন ভ্রান্ত উচ্চাভিলাষের সৃষ্টি করত না।
আবার এমনও হতে পারে, ঈশ্বর ছাড়া কোন বৃহৎ শক্তি আমি ক্ষুদ্র হলেও আমাকে আকর্ষণ করে উচ্চাকাঙ্ক্ষার ছলনাজাল বিস্তার করে টেনে নিয়ে যায় আমাকে অনিবার্য বেগে। কিন্তু আমার মধ্যেও যদি স্বাধীন ইচ্ছা ও অনুরূপ শক্তি থাকত আমার অন্তরে ও বাইরে তাহলে আমি তার সকল প্রলোভনকে প্রতিহত করতে পারতাম, ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারতাম তার সকল ছলনাজালকে।
তাহলে কাকে আমি দোষ দেব? কাকে অভিযুক্ত করব আমার এই অবস্থার জন্য? ঈশ্বরের সংস্কারযুক্ত ভালবাসা সকলের উপরেই সমানভাবে পতিত হয়েছিল। কিন্তু আমার কাছে অভিশপ্ত ও ঘৃণার বস্তু হয়ে উঠেছিল সে ভালবাসা।
কিন্তু আমি ঠিক অভিশপ্ত নই। কারণ তখন আমার মধ্যে ছিল স্বাধীন ইচ্ছা। সেই স্বাধীন ইচ্ছার বলেই আমি স্বাধীনভাবে এমন পথ বেছে নিই যার জন্য আজ আক্ষেপ ও অনুশোচনা করতে হচ্ছে আমায়। আমি এখন কোন পথে যাব? অন্তহীন ক্রোধ ও প্রতিহিংসার পথে, না অন্তহীন হতাশার পথে? সত্যিই আমি বড়ই হতভাগ্য। আমি এখন যে পথে চলেছি তা অন্তহীন নরকের পথ। আমিই এক জীবন্ত নরক।
বর্তমানে নরকের যে গভীরতম প্রদেশে যন্ত্রণাদায়ক জীবন যাপন করি তার থেকেও গভীর এক গহুর তার ভয়ঙ্কর মুখব্যাদান করে গ্রাস করতে আসে আমায়। তার তুলনায় বর্তমানে নরক স্বর্গ বলতে হবে।
হে আমার অন্তরাত্মা, অবশেষে এতদিনে তুমি তোমার ভুল বুঝতে পেরেছ। কিন্তু এখন অনুতাপের মাধ্যমে কি কোন উপায় নেই আমার পাপস্খলনের? কোন ক্ষমা বা মার্জনা নেই আমার জন্য? উন্মুক্ত আছে শুধু আত্মসমর্পণের পথ? আত্মসমর্পণ ছাড়া কি অন্য কোন পথ নেই?
অথচ এই আত্মসমর্পণেই আমার যত কিছু আপত্তি। এই শব্দটাই আমার কাছে এক চরমতম ঘৃণার বস্তু। এই আত্মসমর্পণের কথাটা নরকে আমার অধীনস্থ প্রজাদের কাছে আমাকে এক অনপনেয় লজ্জা আর অপমানের পাত্র করে তুলবে।
আমি শুধু তাদের যত সব আপাত উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি দিয়ে বশীভূত করে রেখেছি, কিন্তু তাদের আত্মসমর্পণ করতে শেখাইনি। আমি যেন মিথ্যা আত্ম-অহঙ্কারের দ্বারা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকেও আমার বশীভূত করতে পারব এমনি একটা ভাব দেখিয়েছি তাদের।
হায়, তারা জানে না কত ব্যর্থ আমার সেই অহংকার। জানে না, সে অহঙ্কারের জন্য কতখানি মূল্য আমায় দিতে হয়েছে। কি ভীষণ আত্মদহনে দগ্ধ হচ্ছে আমার অন্তর। যতই তারা আমাকে নরকের রত্নখচিত সিংহাসনে বসিয়ে হাতে শাসনদণ্ড তুলে দিয়ে সম্মানের সুউচ্চ স্তরে তুলে দেয় ততই আমি নীচে তলিয়ে যাই। আমি শুধু দুঃখেই মহান, অতৃপ্ত অপূর্ণ উচ্চাভিলাষেই আমার যা কিছু আনন্দ।
যদি আমি আমার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করি তাহলে কি পূর্বের সেই গৌরবময় অবস্থা ফিরে পাব? তার সেই উন্নত অবস্থায় পুনরধিষ্ঠিত হওয়ার পর আমি যদি আমার আত্মসমর্পণ প্রত্যাহার করে নিই? অবস্থার দ্বারা প্রপীড়িত হয়ে বাধ্য হয়ে কপট আত্মসমর্পণকালে যে শপথ করব পরে তা যদি তুলে নিই? ঘৃণার ক্ষত যেখানে অন্তরের গভীরে অনুপ্রবিষ্ট হয় সেখানে কোন প্রকৃত পুনর্মিলন সম্ভব হতে পারে না।
এই পুনর্মিলন সম্ভব নয় বলেই আমার পরিণাম আরও খারাপ হতে বাধ্য। আমার পতন হয়ে উঠবে আরও শোচনীয়। শুধু তার আগে আমি একটু বেশি মূল্য দিয়ে একটুখানি বিরাম নিতে চাই, যদিও এই বিরাম বা শান্তি নিতান্ত সাময়িক।