বস্তুত একমাত্র সর্বদশী ঈশ্বর ছাড়া স্বর্গ বা মর্ত্যের কেউ কারো কোন ভণ্ডামি বা ছলনা ধরতে পারে না। যখন কেউ ছলনার আশ্রয় নিয়ে মিথ্যার অবতারণা করে তখন সকলে স্বাভাবিক ক্ষমতার বশে সেই মিথ্যাকে সত্য বলে মেনে নেয়। তখন আমাদের জ্ঞানের দ্বার থাকে রুদ্ধ, সকল সংশয় সেই জ্ঞানের রুদ্ধ দ্বারপথে ঘুমিয়ে থাকে, সরলতা কোন কাজ করে না। সূর্যের প্রতিনিধি এবং স্বর্গের সবচেয়ে তীক্ষ্ণদৃষ্টিসম্পন্ন দেবদূত হয়েও ইউরিয়েল ভণ্ড প্রতারক শয়তানের এই ছলনা বুঝতে পারল না।
ইউরিয়েল শয়তানরাজকে বলল, হে সুন্দর সদাশয়, ঈশ্বরের সৃষ্টিকার্য নিজের চোখে দেখা ও তা দেখে সেই পরমস্রষ্টার গৌরবগান করার বাসনায় তুমি যে তোমার সুরম্য স্বর্গীয় প্রাসাদ ছেড়ে একাকী এই ভূখণ্ডে ঘুরে বেড়াচ্ছ এটা এমন কিছু দোষাবহ ব্যাপার নয়। বরং অতীব প্রশংসার যোগ্য। কারণ অন্য যে কোন দেবদূত স্বর্গ থেকে এই সৃষ্টিকার্যের বিবরণ শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে পারত।
ঈশ্বরের সৃষ্টিকার্য সত্যিই বিস্ময়কর এবং তা জানা সত্যিই আনন্দদায়ক যে অভিজ্ঞতার কথা আনন্দের সঙ্গে স্মৃতির স্বর্ণকোঠায় সংরক্ষিত রাখার যোগ্য। কিন্তু ঈশ্বর ছাড়া আর কার মন সে সৃষ্টির সংখ্যা গণনায় সক্ষম এবং কার এমন অনন্ত জ্ঞান আছে যার দ্বারা সে সৃষ্টির গভীর কারণ হৃদয়ঙ্গম করতে সক্ষম হবে?
আমি জানি, আমি নিজে দেখেছি সৃষ্টির আগে সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে এক অন্ধকার মহাশূন্যতা বিরাজ করত, চারিদিকে ছিল বিরাট বিশৃঙ্খলা। সে সময় মাটি, জল, বাতাস, অগ্নি, আকাশ প্রভৃতি বিশ্বসৃষ্টির এই উপাদান বা ভূতগুলি নিরাকারভাবে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়িয়ে ছিল। এমন সময় ঈশ্বরের একটিমাত্র কথায় সেই নিরাকার উপাদানগুলি এক একটি আকার লাভ করে অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্রের রূপ পরিগ্রহ করে। ঈশ্বরের দ্বিতীয় আদেশে সমস্ত অন্ধকার বিচ্ছুরিত হয়ে যায় এবং উজ্জ্বল আলোকমালায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দশদিক। শৃঙ্খলা নেমে আসে সমস্ত বিশৃঙ্খলার মাঝে। তুমি এখন দেখছ, সেই সব গ্রহ-নক্ষত্রগুলি আপন আপন স্থানে আপন আপন কক্ষপথে কি সুন্দরভাবে ঘুরছে। নিম্নে যে জগৎ দেখছ, সে জগৎ স্বর্গলোক হতে প্রতিফলিত আলোকেই আলোকিত। ঐ পৃথিবীই হলো মানবজাতির বাসভূমি।
দুটি গোলার্ধে বিভক্ত এই জগতে সূর্যের আলো যখন একটি গোর্ধকে আলোকিত করে তখন অন্য গোলার্ধে রাত্রির অন্ধকার বিরাজ করে। তবে সূর্যের আলোয় আলোকিত চন্দ্রের আলো পৃথিবীর নৈশ অন্ধকারকে প্রতিমাসে একপক্ষকাল কিছুটা আলোকিত করে।
এরপর ঊর্ধ্বে হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে ইউরিয়েল বলল, ঐ হলো স্বর্গলোক, আমাদের বাসভূমি। যে পথ দেখিয়ে দিলাম সে পথে যেতে ভুল করো না। আমি এবার চললাম।
শ্রদ্ধা জানাল। ইউরিয়েল চলে গেলে শয়তান শূন্যে ঝাঁপ দিয়ে পৃথিবীর উপকূল অভিমুখে পাড়ি দিল তারপর আর্মেনিয়ার নাইকেত পর্বতে অবতরণ করল।
০৩য় সর্গ
তৃতীয় সর্গ
এ্যাপোকনিগম একদিন স্বর্গলোকে উচ্চকণ্ঠে সতর্ককরে মর্তমানবদের, শয়তানরূপী ড্রাগন তাদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করতে আসবে। কিন্তু হায়, ব্যর্থ হলো সে কণ্ঠস্বর।
ধিক মর্ত্যলোকের অধিবাসীদের। একবার মানবজাতির আদি পিতা-মাতাকে সতর্ক করে দেওয়া হয় এক গোপন শত্রুর আগমন সম্পর্কে। তখন সেই শত্রুর মারাত্মক ফাঁদ এড়িয়ে পালিয়ে যান তারা।
এখন সেই শয়তান ঈশ্বরের অনুগৃহীত মানবজাতির উপর ক্রোধে প্রজ্জ্বলিত চিত্ত হয়ে মানবকুলের আদি পিতা-মাতাকে প্রলোভিত ও স্বর্গচ্যুত করার জন্য এল নরক, থেকে স্বর্গলোকে। এইভাবে ঈশ্বর ও দেবতাদের সঙ্গে প্রথম যুদ্ধে যে হীন পরাজয় স্বীকার করে স্বর্গচ্যুত হয়ে দুর নরকপ্রদেশে গিয়ে তাদের আশ্রয় নিতে হয়, দুর্বলচিত্ত মানুষের উপর সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে চায় শয়তানরাজ।
কিন্তু কৌশলে সে স্বর্গারোহণের ও মানবকুলের আদি পিতা-মাতার সন্ধানলাভে সমর্থ হলেও তার এই কঠিন প্রচেষ্টায় কোন আনন্দের উল্লাস ছিল না, ছিল না কোন গর্বোদ্ধত ভাব। তার বিক্ষুব্ধ বুকের মধ্যে যেন এক জ্বলন্ত এঞ্জিন তার অগ্রপ্রসারী চিত্তকে পিছন থেকে টানছিল। সে স্বভাবত নির্ভীক হলেও এক অজানা শঙ্কা আর সংশয় তার বিপন্ন বিব্রত চিন্তাকে নিপীড়িত করছিল। নরক থেকে স্বর্গে আরোহণ করলেও কোন উত্তরণ ঘটেনি তার চিত্তে। তার অন্তরের অন্তঃস্থলে সে যেন নরকপ্রদেশের কুটিল অন্ধকাররাশিকেই বহন করে এনেছিল। তাই স্বর্গের শান্ত সুন্দর পরিবেশেও এক অশান্ত কু-অভিসন্ধিরূপ নরকাগ্নি জ্বলছিল তার অন্তরে।
সহসা বিবেক তার লুপ্ত সংশয় ও হতাশাকে জাগ্রত করে তুলল। সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতির পীড়ন শুধু হলো তার মনে। সে অতীতে কি ছিল, এখন কি হয়েছে এবং তার এই চেষ্টিত কার্যের যে কুফল হতে পারে, এই সব বিষয় চিন্তিত করে তুলল তাকে। কখনো আনন্দোজ্জ্বল মনোরম স্বর্গোদ্যানের পানে, কখনো ঊর্ধ্বে বিরাজিত স্বর্গলোকের পানে, কখনো মধ্য আকাশে দেদীপ্যমান ও পর্যাপ্ত কিরণমালায় অতিভাস্বর সূর্যের পানে সে তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।
তারপর সে এক গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আপন মনে বলতে লাগল, যে সূর্য, যে তুমি সর্বোচ্চ গৌরবের মুকুটে ভূষিত হয়ে এই নূতন জগতের দেবতারূপে স্বরাজ্যে অধিষ্ঠিত হয়ে আছ এবং যে তোমার চক্ষু হতে বিচ্ছুরিত প্রোজ্জ্বল দৃষ্টিদ্যুতির সামনে নক্ষত্রেরাও লজ্জায় মাথা নত করে, সেই তোমাকে বন্ধুভাবে সম্বোধন করতে পারলাম না।