ক্রমে সে দেখল অনন্ত মহাশূন্যে অসংখ্য গ্রহনক্ষত্র এক একটি আলোকিত জগতের মধ্যে ভাসছে। তাদের মৃদুকম্পিত দেহগুলি দেখে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে তারা যেন ঝুলন্ত অবস্থায় নৃত্য করছে। কিন্তু সর্বত্র এমন এক সুন্দর শৃঙ্খলা বিরাজ করছে যাতে কারো সঙ্গে সংঘাত সংঘটিত হচ্ছে না।
শয়তানরাজ আরও দেখল, সূর্যের জ্বলন্ত কিরণগুলির মাঝে অনেক ভূখণ্ড রয়েছে।
সূর্যমণ্ডলমধ্যবর্তী সেই সব ভূখণ্ডের একটিতে অবতরণ করল শয়তান। সে ভূখণ্ডের সন্ধান আজও কোন জ্যোতির্বিজ্ঞানী পায়নি। সে দেখল সেই ভূখণ্ডে সোনা, রুপো ও হীরকের মত অনেক ধাতুর স্তূপ উজ্জ্বল কিরণমালায় চকচক করছে। তেমন উজ্জ্বল ধাতু মর্ত্যলোকে বা পাতালপ্রদেশের কোথাও দেখা যায় না।
শয়তান আরও দেখল সেই বিশাল ভূখণ্ডের নিম্নদেশ শুধু উজ্জ্বল ধাতুতে পরিপূর্ণ হলেও কোথাও কোন উঁচু বস্তু বা পাহাড়-পর্বত, ঘর-বাড়ি, নদীর জলপথ, কিছুই নেই। চারিদিক উজ্জ্বল, কোথাও কোন ছায়া বা অন্ধকার নেই। যেদিকেই সে দৃষ্টি প্রসারিত করল, কোন বাধা পড়ল না তার দৃষ্টিপথে, চারিদিকেই মনে হতে লাগল উজ্জ্বল ধাতুর নদী বয়ে যাচ্ছে। এখানকার সব ধাতুই নির্বাচিত এবং খাঁটি।
কোনরূপ বিচলিত বা কিছুমাত্র অভিভূত না হয়ে অসমসাহসী শয়তান চারিদিক দেখতে দেখতে বহুদূরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে তাকিয়ে রইল। এইভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর দূরে এক দেবদূতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। কি জন্য একদিন স্বগের মধ্যে এক দেবদূতকে দেখতে পেয়েছিল। সে পিছন ফিরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু পিছন ফিরে থাকলেও তার জ্যোতি কিছুমাত্র কমেনি। তার মাথায় ছিল সোনার টায়রা। তার মাথার চুলগুলো ঘাড়ের উপর ছড়িয়ে পড়েছিল। তার দু’পাশের পাখাদুটি ঝুলছিল।
মনে হচ্ছিল কোন এক বড়রকমের কার্যভারে বিব্রত ছিল সেই দেবদূতটি। অথবা সে ছিল গভীর কোন চিন্তায় মগ্ন।
সেই দেবদূতকে দেখে নতুন আশায় উদ্দীপিত হয়ে উঠল শয়তানরাজের অন্তর। সে ভাবল, কোন পথে উড্ডীন হয়ে সে মানবজাতির পরম সুখের আকাঙ্ক্ষিত স্থান তার গন্তব্যস্থল স্বর্গে উপনীত হতে পারবে তা ঐ দেবদূতই বলে দিতে পারবে।
কিন্তু ঐ দেবদূতকে কিছু বলার আগে সে তার রূপ পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। কারণ এই শয়তানের বেশে তার কাছে গেলে তার বিপদ হতে পারে অথবা তার গন্তব্যস্থলে যেতে বিলম্ব হতে পারে।
এই ভেবে শয়তান এক দেবদূতের রূপ পরিগ্রহ করল। সে দেবদূত বয়সে যুবক না হলেও এক অনন্ত যৌবনের উজ্জ্বল দীপ্তি শোভা পাচ্ছিল তার মুখে। তার এই ছদ্মবেশ এমনই সার্থক হয়ে উঠেছিল যে তার প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে এক স্বর্গীয় সুষমা ঝরে পড়েছিল। তার কুঞ্চিত কেশপাশ দু গালের উপর ছড়িয়ে পড়েছিল। বিচিত্র যাদুকাঠি।
দেবদূতের এই ছদ্মবেশ ধারণ করে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে লাগল শয়তানরাজ। কিন্তু সে দেবদূতের কাছে যাবার আগেই তার উপস্থিতির কথা জানতে পারল সেই দেবদূত। তার উজ্জ্বল মূর্তিটি নিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে।
তখন সেই দেবদূতের মুখ দেখেই তাকে চিনতে পারল শয়তান। সে ছিল আর্কেঞ্জাল ইউরিয়েল। স্বর্গলোকে ঈশ্বরের সিংহাসনের কাছে যে সাতজন দেবদূত তাঁর আদেশ পালনের জন্য সর্বদা প্রস্তুত হয়ে থাকে ইউরিয়েল ছিল তাদেরই একজন। তারা সব সময় জলে স্থলে অন্তরীক্ষে ত্রিভুবনের সর্বত্র ঈশ্বরের বার্তা বহন করে বেড়ায়।
ইউরিয়েলকে সম্বোধন করে শয়তান বলল, হে ইউরিয়েল, যে সাতজন দেবদূত এক গৌরবময় উজ্জ্বলতায় মণ্ডিত হয়ে ঈশ্বরের সিংহাসনের সম্মুখে বিরাজিত থাকে তুমি তাদের মধ্যে প্রথম। তোমারই দৌত্যের দ্বারা ঈশ্বরের পুত্ররা তাদের পরমপিতার সকল অভিলাষ অবগত হন। স্বর্গলোকে ঊর্ধ্বতন প্রদেশ হতে ঈশ্বরের সকল বার্তা, সকল আদেশ তোমারই মাধ্যমে প্রচারিত হয়। তুমি আজ এখানেও হয়ত ঈশ্বরেরই কোন পরম বিধান বহন করে এনেছ।
ঈশ্বরের যে সব বিস্ময়কর সৃষ্টি চারিদিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে সেই সব সৃষ্টি এবং বিশেষ করে তার সবচেয়ে অনুগৃহীত ও তার আনন্দের বস্তু মানবজাতি সম্পর্কে কিছু জানার কৌতূহলের তাড়নায় আমি একাকী ঘুরে বেড়াচ্ছি। হে উজ্জ্বলতম দেবদূত, চারিদিকে যে সব উজ্জ্বল গ্রহ মহাশূন্যে ঘূর্ণমান তাদের কোটিতে মানবজাতি বাস করে অথবা তাদের কি কোন নির্দিষ্ট বাসভূমি নেই? সব গ্রহতেই বাস করে সাময়িকভাবে। বল, কোথায় কিভাবে তাদের দেখা পাব? তাদের কি গোপনে দূর থেকে দেখতে হবে, না কাছে গিয়ে প্রকাশ্যে দেখব? এক অবর্ণনীয় কামনায় অভিভূত হয়ে পড়েছি আমি তাদের দেখার জন্য।
যে ঈশ্বর মানবজাতিকে কত বড় জগৎ দান করেছেন অনুগ্রহবশত, যাদের উপর কত মহিমা ঢেলে দিয়েছেন, সেই মানবজাতিকে দর্শন করে পরমস্রষ্টার জয়গান করতে চাই। এই পরমস্রষ্টা ঈশ্বর ন্যায়সঙ্গতভাবেই তার বিদ্রোহী শত্রুদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে নরকের গভীরতম প্রদেশে নিক্ষেপ করেছেন এবং তাদের স্থান পূরণ করার জন্য এক নতুন সুখী জাতি সৃষ্টি করেছেন। এই জাতিই হলো মানবজাতি। যাতে তারা ঈশ্বরের আরও ভালভাবে সেবা করতে পারে তার জন্যই এই মানবজাতিকে সৃষ্টি করেন ঈশ্বর। তিনি পরমপিতা।
এইভাবে দেবদূতের ছদ্মবেশে শয়তান তার কু-অভিসন্ধি সিদ্ধির জন্য এক বিরাট মিথ্যার অবতারণা করল। কিন্তু তার সেই ছলনা ও মিথ্যা ধরতে পারল না ইউরিয়েল।