কিছুক্ষণের মধ্যে সেই নরকের অন্ধকারে জ্বলন্ত অগ্নিশিক্ষার আভায় একজনকে চিনতে পারল আদিপিতা। ক্ষমতা ও অপরাধে তার পরেই যার স্থান, দীর্ঘকাল আগে প্যালেস্টাইনে যার সঙ্গে পরিচয় হয় তার সেই বীলজীবাব নামে এক শয়তানকে দেখে চিনতে পারল সে। স্বর্গে যাকে শয়তান বলা হত সেই বীলজীবাব এবার নরকপ্রদেশের ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধতাকে ভঙ্গ করে উদ্ধতভাবে বলল, তুমি যদি সে-ই হও তাহলে কেমন করে তোমার পতন ঘটল? একদিন যে তুমি কত সুখে ছিলে, এক স্বর্গীয় জ্যোতিতে কত উজ্জ্বল ছিল তোমার দেহাবয়ব, এখন তুমি আর সেই ব্যক্তি নেই। কত পরিবর্তন হয়েছে তোমার! একদিন আমরা দুজনে মিলেমিশে একই আশায় সঞ্জীবিত ও একই আঘাতে অভিভূত ও একই ভাবনায় ভাবিত হয়ে আমাদের গৌরবময় উদ্দেশ্যসাধনের পথে এগিয়ে চলি আমরা। আবার এখন একই দুঃখ আর সর্বনাশের কবলে পতিত হয়েছি আমরা। কত উঁচু থেকে কত নীচে পড়েছ তা একবার দেখ তো। বজ্রের যে এত শক্তি এর আগে তা জানতাম না আমরা।
কিন্তু এই সব দুঃখকষ্ট সত্ত্বেও বিন্দুমাত্র অনুশোচনা জাগেনি আমার মধ্যে। কোন পরিবর্তন হয়নি আমার মনের। এমন কি আমাদের শক্তিমান বিজয়ী প্রতিপক্ষ এর থেকে আরো যে বেশি শাস্তি দেবে আমাদের, তার জন্যও ভয় করি না আমি। যদিও আমার বহিরঙ্গের জ্যোতি আর জৌলুস আর নেই, তথাপি আমি দৃঢ়সংঙ্কল্প। আমার আহত অপমানবোধ ঘৃণা আর প্রতিশোধ বাসনার উদ্রেক করেছে আমার মনে। কারণ এর আগে আমি একবার বিদ্রোহী আত্মাদের সহায়তায় স্বর্গরাজ্যে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করি। সে যুদ্ধ কাঁপয়ে তোলে তার সিংহাসনকে তবু সে যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারিনি আমরা। কিন্তু আমরা পরাভূত হলেও অপরাজেয় রয়ে গেছে আমাদের মনোবল। দুর্মর ঘৃণা, প্রতিশোধ বাসনা আর দুর্দমনীয় সাহসের দ্বারা কি জয়লাভ করতে পারব না আমরা? আমাদের এই অদম্য অনিবারণীয় শক্তি আর সাহসই এক পরম গৌরবের বস্তু। আমাদের প্রতিপক্ষ যতই প্রবল ও শক্তিশালী হোক না কেন, এ গৌরব ছিনিয়ে নিতে পারবে না আমাদের কাছ থেকে। শত্রুর সামনে নতজানু হয়ে তার করুণা ভিক্ষা করতে কখনই পারব না আমরা। তার থেকে যে শত্রু তার শক্তির দম্ভের দ্বারা তার সমগ্র সামাজ্যকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছে, যে আমাদের শোচনীয় পতন ঘটিয়ে অমিত অপমান আর লজ্জার বস্তুতে পরিণত করেছে আমাদের, সে শত্রুর বিরোধিতা করব আমরা সমস্ত শক্তি দিয়ে। যদিও ভাগ্যের বলে বলীয়ান দেবতাদের সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পতন ঘটেনি এখনো পর্যন্ত, তথাপি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা জেনেছি আমাদের শক্তিও কম নয়। আমাদের এই পরীক্ষিত শক্তির সত্যতা, দূরদর্শিতা, বলিষ্ঠ আশা আর অনমনীয় সংকল্পের দ্বারা অগ্রসর হয়ে সেই শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারি যে শত্রু বর্তমানে বিজয়গর্বে মত্ত হয়ে অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে স্বর্গরাজ্যে। ছলে-বলে সে যুদ্ধে জয়লাভও করতে পারি আমরা।
এইভাবে সেই অধঃপতিত দেবদূত গর্বে উন্মত্ত, যন্ত্রণায় কাতর এবং আশাহত বেদনায় অভিভূত হয়ে এই কথাগুলি বললে আমাদের দুঃসাহসী শয়তান উত্তর করল, হে রাজন, বহু প্রতিষ্ঠিত রাজশক্তির প্রধান, তুমি এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধে শক্তিশালী দেবদূতদের নির্ভীকভাবে নেতৃত্ব দান করে সনাতন রাজশক্তিকে বিপন্ন করে তোল এবং তার প্রভুত্বকে এক চরম পরীক্ষার সামনে উপস্থাপিত করো। জানি না তাদের শক্তির জোরে, অথবা দৈব বা নিয়তির প্রভাবে পরাজয় ঘটল না তোমার শত্রুপক্ষের। যাই হোক, আমি আমাদের এই শোচনীয় পরাজয়, পতন আর সর্বনাশের ঘটনাটি বিশেষ গুরুত্বসহকারে বিচার করে দেখেছি। আমাদের গৌরবসূর্য অস্তমিত হলেও এবং অন্তহীন দুঃখ আমাদের সকল সুখ ও অধিকারের মর্যাদাকে গ্রাস করে ফেললেও আমাদের অদম্য মনোবল এবং অপরাজেয় আত্মশক্তি ফিরে আসছে আবার। যে বিজয়ী আমাদের মত শক্তিকে পরাভূত ও ব্যর্থ করে দিয়ে এই বিড়ম্বনা ও যন্ত্রণার রাজ্যে নিক্ষেপ করেছে আমাদের, সে বিজয়ীকে সর্বশক্তিমান না বলে উপায় নেই।
এখন আমাদের ঠিক করতে হবে, আমরা কি সেই সর্বশক্তিমান বিজয়ীর প্রতিহিংসাকে চরিতার্থ করার জন্য এই অতল নরকাগ্নির মধ্য থেকে তার দাসরূপে তার যত আদেশ অপ্রতিবাদে পালন করে যাব? কিন্তু আমাদের শক্তি যখুন এখনো অটুট ও অক্ষত রয়ে গেছে তখন কেন আমরা অনন্তকাল ধরে অনন্ত শান্তির বোঝা বহন করে। যাব? কি লাভ হবে তাতে আমাদের?
একথা শুনে সেই অধঃপতিত দেবদূতরূপী শয়তান বীলজীবাব সঙ্গে সঙ্গে উত্তর করল, দুঃখকষ্ট যত বেশিই হোক, তাতে দুর্বল হয়ে ভেঙে পড়া আরও দুঃখজনক। আমাদের বিরুদ্ধ শক্তির মঙ্গল সাধন করা কখনই উচিই হবে না আমাদের। তার ইচ্ছার বিরোধিতা করে তার অমঙ্গল করে যাওয়াই হবে আমাদের পক্ষে আনন্দের ব্যাপার। আমাদের পরমশ সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যদি আমাদের চরম দুরবস্থা হতে নিজের কোন স্বার্থ পূরণ করতে চায় তাহলে আমরা সর্বশক্তি দিয়ে সে উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দেব এবং তার ক্ষতি করার চেষ্টা করব। আমাদের চেষ্টা যদি ফলবতী হয় এবং আমরা যদি ব্যর্থ না হই, তাহলে সে দুঃখ পাবে এবং সে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়বে। একবার দেখ, কিভাবে সেই বিজয়ী শত্রু প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তার সহকারীদের নিয়ে অগ্নিঝড়, বস্ত্র ও বিদ্যুৎসহ স্বর্গের প্রান্তদেশ পর্যন্ত আমাদের তাড়া করে আসে এবং স্বর্গলোকের সেই খাড়াই উচ্চতা হতে নীচে ফেলে দেয় আমাদের। এখন অবশ্য আর সেই বজ্রের কোন গর্জন এই নরকগহ্বরে ধ্বনিত হয় না।