এই দেখে তিনি তাঁর পুত্রকে বললেন, হে আমার একমাত্র পুত্র, দেখতে পাচ্ছ আমাদের ক্রোধের বশবর্তী হয়ে কি করছে শয়তান? নরকের কারাগার তাকে আবদ্ধ করে রাখতে পারেনি, কোন সীমার শাসন সে মানেনি, তূপাকৃত শৃঙ্খল তাকে দমন করতে পারেনি, সীমাহীন অন্ধকার ও শূন্যতা, মহাসমুদ্রের অনন্ত জলরাশি তার গতিরোধ করতে পারেনি। আমাদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য এক আত্মঘাতী সংকল্পে মত্ত হয়ে উঠেছে সে। কিন্তু সে জানে না এর দ্বারা কিছুই করতে পারবে না সে। তার বিদ্রোহী উদ্ধত মস্তকের উপর দ্বিগুণ পরিমাণে চাপবে শুধু শাস্তির বেদনাভার। সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে সমস্ত বিধিনিষেধের বেড়াজাল অতিক্রম করে এখন সে পাখা মেলে স্বর্গলোকের কাছাকাছি আলোর মধ্যে চলে এসেছে।
সে সরাসরি যেতে চায় মানবজাতির দ্বারা অধ্যুষিত নবনির্মিত পৃথিবীতে। বলপ্রয়োগ অথবা ছলনার দ্বারা সে জাতিকে ধ্বংস করতে চাইবে সে। মানু শয়তানের আপাতমধুর ও চাককিপূর্ণ যত সব মিথ্যাকথা শুনে ভুলে যাবে। ফলে তারা ঈশ্বরের প্রতি তাদের আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি ও ঈশ্বরের আদেশ লঙঘন করবে। এইভাবে তারা এবং তাদের বংশধরেরা অধঃপতিত হবে।
কিন্তু সে অধঃপতন ঘটবে কার দোষে? তার নিজের দোষ ছাড়া এ দোষ কার? বড় অকৃতজ্ঞ এই মানবজাতি। তাদের যা যা প্রয়োজন তা তারা সব পেয়েছে আমার কাছ থেকে। আমি তাদের ন্যায়-অন্যায় বোধ দান করেছি। এই বোধের দ্বারা তারা দাঁড়াতেও পারে আবার তাদের পতনও ঘটতে পারে। কারণ ন্যায়-অন্যায় বোধের সঙ্গে তাদের ইচ্ছামত চলার স্বাধীনতাও দান করেছি। স্বর্গের দেবদুতদেরও আমি এমনি করে স্বাধীনভাবেই সৃষ্টি করেছিলাম। তাদের মধ্যে অনেকে এই স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার করে দাঁড়িয়েছিল, আবার অনেকে সে স্বাধীনতার অপব্যবহার করে অধঃপতিত
তারা স্বাধীন হলেও একনিষ্ঠ আনুগত্য, স্থায়ী বিশ্বাস ও অচলা প্রেমভক্তির কি প্রমাণ কি পরিচয় তারা দান করেছে? কি প্রশংসা তারা করেছে? তাদের আনুগত্য থেকে কতখানি আনন্দ আমি লাভ করেছি? তারা শুধু নিজেদের প্রয়োজনসিদ্ধির জন্য খুশিমত কাজ করে গেছে। তাদের ইচ্ছার স্বাধীনতা এবং যুক্তিবোধের যথেচ্ছ অপব্যবহার করে সে দুটিকে ব্যর্থতায় পরিণত করে তুলেছে তারা। এ দুটিকে নিষ্ক্রিয় করে তুলে শুধু নিজেদের প্রয়োজনের সেবা করে গেছে। আমার সেবা করেনি তারা।
এইভাবে ইচ্ছামত চলার অধিকার আমিই দান করেছিলাম এবং এইভাবে তাদের সৃষ্টি করেছিলাম যারফলে তারা তাদের পতনের জন্য তাঁদের স্রষ্টার উপরে ন্যায়সঙ্গতভাবে কোন দোষারোপ করতে পারবে না। তাদের নিয়তিকেও কোন দোষ দিতে পারবে না। পূর্বনিদিষ্ট বিধির বিধান ও তাদের ভবিষ্যৎকাল অদের ইচ্ছাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে বলেই তারা বিদ্রোহ করে আমার বিরুদ্ধে। আমি যদি একথা আগে হতে জানতে পারতাম তাহলে তাদের এই ভবিষ্যৎকাল কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারত না এই বিদ্রোহের উপর। তাদের স্বাধীন বিচারবুদ্ধি ও ইচ্ছানুসারেই আমার অমোঘ– বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করে তারা। নিজেদের কর্মদোষে ও অপরাধের জন্য নিজেদের দাসত্ব ডেকে না আনা পর্যন্ত তারা স্বাধীনই থাকবে। আমার অমোঘ অপরিবর্তনীয় বিধান অনুসারেই তারা স্বাধীনতা পায়। কিন্তু তারা নিজেদের দোষে নিজেদের পতন ডেকে আনে। তারা শয়তানের দ্বারা প্রলুব্ধ ও প্ররোচিত হয়ে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে ওঠে। তবু তারা আমার অনুগ্রহ এবং করুণা লাভ করবে। স্বর্গ আর মর্ত্যলোকের অধিবাসীরা আমার করুণা আর ন্যায়বিচার লাভ করে ধন্য হবে। আমার গৌরব উজ্জ্বলভাবে কিরণ দান করবে স্বর্গ ও মর্ত্যলোক ব্যাও করে।
এইভাবে ঈশ্বর তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন। আনন্দরূপ অমৃতের এক অক্ষয় দিব্য সৌরভে আমোদিত হয়ে উঠল যেন সমগ্র স্বর্গলোক। এক নূতন আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠল দেবদূতেরা। তার পরমপিতার এক গৌরবোজ্জ্বল দীপ্তিতে দীপ্তিমান হয়ে বসেছিল তার পুত্র। অনন্ত প্রেম আর করুণার এক স্বর্গীয় দ্যুতি উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছিল তার মুখমণ্ডলে।
ঈশ্বরের পুত্র এবার বলতে লাগলেন, হে পরমপিতা, তোমার শেষ বাক্যটির জন্য স্বর্গে-মর্ত্যে ঘোষিত হবে তোমার গৌরব। বিভিন্ন স্তোত্র ও পবিত্র প্রার্থনার সঙ্গীতে ধ্বনিত হবে তোমার জয়গান। কিন্তু তোমার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান তোমার প্রিয় সৃষ্ট মানবজাতি কি তাদের নির্বুদ্ধিতার জন্য শয়তানের ছলনা ও প্রতারণার শিকার হয়ে অধঃপতিত হবে?
হে পরমপিতা, যে তুমি সমস্ত ন্যায়বিচারের অধিকর্তা এক মূর্ত প্রতীক সেই তোমার পুত্রের এমন অবস্থা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। এত সহজে কি তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে এবং তোমার উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে তুলবে? সে কি তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে তোমার মহত্ত্বকে খর্ব করে তুলবে? সে কি সমগ্র মানবজাতিকে প্রলোভিত করে তাদের সকলকে তার সঙ্গে নরকে নিয়ে যাবে? অথবা তুমি কি তোমার নিজের গৌরবজনক সৃষ্টির নিজেই এইভাবে উচ্ছেসাধন করবে?
তাঁর পুত্রের এই কথার উত্তরে পরমপিতা ও স্রষ্টা বললেন, হে আমার প্রিয় পুত্র, আমার আত্মার আনন্দ, আমার অন্তরের অন্তর, তোমার মধ্যেই আমার জ্ঞান ও শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে। তুমি আমার মনের কথাই ব্যক্ত করেছ। আমার অমোঘ বিধান এবং উদ্দেশ্য হলো এই যে, মানবজাতি সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হবে না। তাদের ইচ্ছাশক্তির দ্বারা নয়, আমার অনুগ্রহের দ্বারাই সমস্ত বিপদ হতে উদ্ধার লাভ করবে তারা। তাদের উচ্ছল কামনা-বাসনার তাড়নায় পাপের বশবর্তী হয়ে যে শক্তি হারাবে তারা সে শক্তি আমি পুনরায় দান করবে তাদের। আমার সাহায্য লাভ করে তাদের শত্রুর সব কাণ্ড ও শয়তানিকে ব্যর্থ করে আবার যথাস্থানে দাঁড়াতে পারবে তারা। আমার কাছ থেকে অনুই ও সাহায্য লাভ করে তারা বুতে পারবে তাদের অধঃপতিত অব। কত সোশী এবং জানতে পারবে একমাত্র আমার দ্বারাই উদ্ধার লাভ করেছে তারা।