মানবজাতির প্রতি ঈশ্বরের অশেষ করুণা ও অনুগ্রহের জন্য তার মানবসন্তান তার পরমপিতা ঈশ্বরের গুণগান করতে লাগলেন। কিন্তু ঈশ্বর তাকে এই বলে সতর্ক করে দিলেন যে, মানুষ ঈশ্বরের বিধান যদি যথাযথভাবে মেনে না চলে, তার ন্যায়পরায়ণতা ও বিচারবুদ্ধির পরিচয় দিতে না পারে তাহলে সে তাঁর কোন অনুগ্রহ লাভ করতে পারবে না। মানবজাতির সবচেয়ে বড় দোষ তারা ঈশ্বরের সমকক্ষতা অর্জনের উদ্ধত উচ্চাভিলাষের দ্বারা তারা রুষ্ট করে তুলেছে ঈশ্বরকে। এই অপরাধের জন্যই অপরিহার্য মৃত্যুর দ্বারা খণ্ডিত তাদের জীবন। যদি তাদের মধ্যে কোন যোগ্য ব্যক্তি সমগ্র মানবজাতির এই পাপের সমুচিত শাস্তি মাথা পেতে নেবার জন্য এগিয়ে না আসে তাহলে এই মরণশীল জীবন থেকে মহাজীবন লাভ করতে কোনদিন পারবে তারা। ঈশ্বরের সেই পুত্র বলল, মানবজাতির মুক্তির জন্য সে শাস্তিভোগ করতে রাজী আছে। ঈশ্বর মেনে নিলেন তার প্রস্তাব। তাকে ঈশ্বরপুত্র হিসাবে অবতার দান করলেন এবং স্বর্গ ও মর্ত্যের সকলের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মহান করে তুললেন। তিনি দেবদূতদের তার মহত্ত্বকে স্বীকার করে তাকে বরণ করে নিতে আদেশ দিলেন। দেবদূতেরা তখন তাদের বীণা বাজিয়ে ঈশ্বর ও তাঁর পুত্রের জয়গান করতে লাগল।
ইতিমধ্যে শয়তান পৃথিবীর শেষ প্রান্তে এক ফাঁকা জায়গায় এসে অবতরণ করল। ঘুরতে ঘুরতে সে এক উপত্যকায় এসে পড়ল। তারপর সে স্বর্গের দ্বারদেশে এসে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল। ক্রমে সে আকাশের উপরে সৌরমণ্ডলের কক্ষপথে এসে পড়ল। সেখানে সে ইউরিয়েল নামে এক দেবদূত প্রহরীর দেখা পেল। তখন সে এক নিম্নস্তরের দেবদূতের বেশ ধারণ করল। তখন সে ঈশ্বরসৃষ্ট নূতন মানবজগতের সবকিছু দেখার জন্য এক প্রবল কৌতূহল অনুভব করল।
হে পবিত্র জ্যোতি, স্বর্গের প্রথমজাত সন্তান, আমি কি তোমার মহিমা অবিকৃতভাবে প্রকাশ করতে পারি? যে ঈশ্বর এক পরম জ্যোতিস্বরূপ, সেই জ্যোতির্ময় পরম পুরুষের সঙ্গে একই সঙ্গে আপনা থেকে সৃষ্ট হয়ে অনন্তলোকে বিরাজ করছ। অনন্তকাল ধরে আদিঅন্তহীন যে পবিত্র ধারায় তুমি প্রবাহিত হয়ে চলেছ তার উৎস কোথায় তা কে জানে?
যখন সৌরমণ্ডল ও আকাশের সৃষ্টি হয়নি তখনও তুমি ছিলে। যখন ঈশ্বরের ইচ্ছায় ও আদেশে ধীরে ধীরে পৃথিবী জেগে ওঠে এবং জল সৃষ্ট হয় তারও আগে তুমি অনন্ত মহাশূন্যে নিরাকার অবস্থায় বিরাজ করতে। উদ্ধত পাখা মেলে আমি আবার তোমাকে দর্শন করতে এসেছি।
আমি স্টাইজিয়ার নারকীয় নদী পার হয়ে অনেক অন্ধকার আকাশপথ অতিক্রম করে অনন্ত রাত্রির প্রশস্তি গাইতে গাইতে কখনো নিচের দিকে নেমে, কখনো উপরের দিকে উঠে বহু ক্লেশ সহ্য করে এখানে এসেছি। তোমার সর্বব্যাপী পরম জ্যোতি পুনরায় দর্শন করতে চাই আমি। কিন্তু সে জ্যোতি হতে নিঃসৃত কোন আলোকরশ্মি পরিদৃশ্য হয়ে উঠছে না আমার সম্মুখে। এই নৈশনিবিড় অন্ধকারের যেন শেষ নেই। কোন প্রভাতের আলো দেখছি না কোন দিকে। তবে কি ঘন কুজ্বটিকাজাল ও মেঘমালার দ্বারা সমাচ্ছন্ন হয়ে আছে তোমার জ্যোতির্মালা?
তবু আমি অদম্য ও অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে চলেছি। কোন ছায়াচ্ছন্ন কুঞ্জবনে অথবা আলোকোজ্জ্বল কোন পর্বতশিখরে অথবা নির্মল জলের ঝর্ণাধারা তোমার পদধৌত করে কলস্বরে প্রবাহিত হয়ে চলে আমি সেখানে চলে যাই নিশীথ অন্ধকারে।
কিন্তু মাঝে মাঝে আমি আমারই মত দুজন কবির কথা ভুলে যাই। তারা হলেন প্রাচীন থ্রেসের কবি থেমিরিস আর এশিয়া মাইনরের অন্তর্গত মেওনিয়ার কবি হোমার। এঁরা দুজনেই অন্ধ ছিলেন। তাঁরা ছিলেন চারণ কবি এবং গায়ক। অন্ধকার বনভূমিতে নাইটিঙ্গেল পাখি যেমন গান করে, তেমনি তারা সুমধুর স্বরে গান গেয়ে ঘুরে বেড়াতেন বিভিন্ন স্থানে।
মাসের পর মাস, ঋতুর পর ঋতু আসে, তবু আলোকোজ্জ্বল কোন দিনের মুখ দেখতে পাই না আমি। বসন্তের পুষ্পদ্যান ও গ্রীষ্মের গোলাপ কখনো চোখে পড়ে না আমার। চারণরত কোন পশুর পাল অথবা কোন মানুষের স্বর্গীয় সুষমাসমৃদ্ধ মুখ দেখতে পাই না আমি।
তার পরিবর্তে নিয়তনিবিড় মেঘমালা আর অন্তবিহীন অন্ধকার পরিবৃত করে রেখেছে আমায় সব সময়ের জন্য। আনন্দময় মানবজগৎ হতে বিচ্ছিন্ন আমি সম্পূর্ণরূপে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডব্যাপী এক সীমাহীন শূন্যতা আর অন্ধকার ছাড়া আর কোন জগৎ ও জীবনের কথা জানা নেই আমার। প্রকৃতি জগতের কোন সুন্দর বস্তু চোখে পড়ে না আমার। আমার অন্তরলোককে উদ্ভাসিত করো যাতে আমি অপরিদৃশ্যমান সকল বস্তু অবলোকন করতে পারি। আমার মন হতে সকল অন্ধকার বিদূরিত করে আমার অন্তরের চক্ষুকে উন্মীলিত করো।
ঠিক সেই সময় সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যদি তার স্বর্গের সিংহাসন হতে নিম্নে তার দৃষ্টিনিক্ষেপ করতেন তাহলে তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে একনিমেষে নিরীক্ষণ করতে পারতেন। তাঁর চারপাশে তখন স্বর্গলোকের জ্যোতিষ্মন পবিত্র বস্তুগুলি ঘনবদ্ধ নক্ষত্ররাজির মত বিরাজ করছিল। তার দিকে তার ডান পাশে তার একমাত্র পুত্র প্রদীপ্ত গৌরবে বসেছিল।
মর্ত্যলোকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে তিনি দেখলেন মানবজাতির আদি পিতামাতা তখন একটি সুন্দর কাননে অনাবিল অখণ্ড আনন্দ আর অতুলনীয় প্রেমের ফল পেড়ে খাচ্ছিল পরম সুখে।
এরপর তিনি নরক আর মর্ত্য আর নরকপ্রদেশের মধ্যবর্তী অন্ধকার শূন্যতার উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখলেন শয়তান ক্লান্ত পাখা মেলে পৃথিবীর প্রান্তভূমিতে দেওয়াল বেয়ে উঠে পদস্থাপনের চেষ্টা করছে। স্বর্গের সিংহাসনে বসে থেকে শয়তানকে দেখার পর তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালের সব কিছু দেখতে পেলেন।