এই বলে সে তার হাতের চাবি দিয়ে তালা খুলে নরকের দরজার বিশাল লৌহকপাটগুলো খুলে দিল। সেই কপাটগুলো খোলার সময় বজ্রগর্জনের শব্দ হলো এবং তাতে সমস্ত নরকপ্রদেশ কেঁপে উঠল।
সেই দরজা খুলে দিল সে। কিন্তু তা বন্ধ করবার শক্তি ছিল না তার। উন্মুক্ত রয়ে গেল সেই বিশাল দরজা যাতে রথ ও অশ্বসহ এক বিশাল বাহিনী যাতায়াত করতে পারে। ধূম আর অগ্নিশিখা নির্গত হচ্ছিল সেই দ্বারপথ দিয়ে।
তারা সেই উন্মুক্ত দ্বারপথ দিয়ে দেখল তাদের সামনে এক অন্ধকার মহাসমুদ্র অন্তহীন বিশালতায় প্রসারিত। সে মহাসমুদ্রের কোন দৈর্ঘ্য নেই, প্রস্থ নেই, কোন সীমা-পরিসীমা নেই। কোন স্থান-কাল নেই। সেখানে বিরাজ করে শুধু অনন্ত রাত্রির গভীর অন্ধকার আর বিশৃঙ্খলা, বিক্ষোভ আর সীমাহীন অরাজকতা। সেখানে উত্তাপ, শীতলতা, আদ্রতা আর শুষ্কতা–এই চারটি দুর্ধর্ষ শক্তি প্রভুত্বলাভের জন্য এক অপরিসীম দ্বন্দ্বে চিরপ্রমত্ত। তাদের সঙ্গে আছে তাদের আপন বংশজাত অসংখ্য অণু পরিমাণ জ্বণ।
কখনো বাতাস, কখনো বিক্ষোভ, কখনো খেয়ালী নিয়তি বা দৈব আধিপত্য করে অন্যদের উপর। সে সমুদ্রের কোন কূল নেই। শেষ নেই, সীমা নেই, আলো নেই, অগ্নি নেই। সেই চির অন্ধকার সমুদ্রই প্রকৃতির গর্ভদেশ এবং সমাধিগহ্বর। সেই অন্ধকার সমুদ্রের মধ্যে পরস্পরবিরুদ্ধ প্রাকৃতিক শক্তিগুলি চিরকাল ধরে সংগ্রাম করে চলেছে পরস্পরের সঙ্গে।
নরকদ্বার হতে নির্গত হয়ে নরকপ্রান্তের সেই অন্ধকারাবৃত সমুদ্রকূলের উপর হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে সেই সমুদ্র অতিক্রম করার কথা বিহ্বল হয়ে ভাবতে লাগল শয়তানরাজ। প্রবল ঝড় আয় সমুদ্রতরহের প্রমত্ত গর্জনের সঙ্গে আপীড়িত হচ্ছিল তার কর্ণকুহর।
অবশেষে নৌকার পালের মতো চওড়া পাখাগুলো মেলে মাটি থেকে ধূমরাশি ভেদ করে শয়তানরাজ লাফ দিল শূন্যে। সেই অন্ধকার শূন্যতার মধ্য দিয়ে আকাশপথে সমুদ্র, জলাশয়, পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে লাগল সে। কিন্তু চারদিক থেকে আসা প্রকৃতিজগতের নানা বিক্ষোভ ও প্রচণ্ড শব্দে অভিভূত হয়ে পড়ল সে।
অবশেষে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সে প্রকৃতিকে সম্বোধন করে বলতে লাগল, হে প্রাকৃতিক শক্তিবৃন্দ, হে আদিম রাত্রি এবং বিশৃঙ্খলার অপদেবতাগণ, গুপ্তচর হয়ে তোমাদের গোপন কর্ম জানতে বা কোনরূপে বিব্রত করতে আসিনি আমি। আমি এই শূন্য। অন্তহীন অন্ধকারে আবৃত তোমাদের রাজ্যের মধ্যে এমন এক পথের সন্ধান করছি যে পথ আমাকে নিয়ে যাবে আলোকিত এক নতুন জগতে। তোমরা আমায় পথ দেখিয়ে দাও। আমায় সঠিক পথ বলে দাও।
তখন এক অদৃশ্য কণ্ঠস্বর শয়তানকে বলল, হে বিদেশী আগন্তুক, আমি তোমাকে চিনি, আমি জানি তুমি কে। তুমি হচ্ছ অধঃপতিত দেবদূতদের শক্তিশালী নেতা। স্বর্গের রাজা ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য নরকে নিক্ষিপ্ত হয়েছ তুমি। আমাদের এই রাজ্যের নিম্নে তোমাদের বর্তমান বাসস্থান অন্ধকার নরকপ্রদেশ বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। আমাদের রাজ্যের উর্বদেশে স্বর্গ ও পাতালের মাঝখানে সম্প্রতি এক নূতন জগতের সৃষ্টি হয়েছে। সে জগৎ একটি সোনার শিকল দিয়ে স্বর্গের সেই দিকের সঙ্গে বাঁধা আছে যে দিক থেকে তোমরা নিক্ষিপ্ত হয়েছ। সে জগৎ যদি তোমার গন্তব্যস্থল হয় তাহলে তা বেশিদূর নয় এখান থেকে। যাও, বেগে ধাবিত হও সেইদিকে।
এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আর সেখানে না থেমে আবার যাত্রা শুরু করল শয়তানরাজ। তার যাত্রাপথের আর বেশি বাকি নেই। অতি কষ্টে অকূল সমুদ্র পার হয়ে তার কুলের কাছে এসে পড়েছে একথা ভেবে খুশি হয়ে নূতন উদ্যমে পাখা মেলে ঊর্ধ্বে উঠে যেতে লাগল সে। আরও বাড়িয়ে দিল তার উড়ে চলার গতিবেগ এক জ্বলন্ত আগুনের পিরামিড যেমন ঝড়-ঝঞ্জার মধ্য দিয়ে অনন্তবিস্তৃত আকাশে উড়ে চলে, জেসনের গ্রীকজাহাজ যেমন একদিন দ্রুতবেগে ছুটে চলে অথবা গ্রীকবীর ইউলিসিসের জাহাজ যেমন একদিন চ্যামিবডিসের ঘূর্ণনবর্ত এড়িয়ে দ্রুতবেগে এগিয়ে যায় তেমনি দ্রুতবেগে পাখা মেলে উড়ে চলতে লাগল শয়তানরাজ।
ঈশ্বরের বিধানে অন্ধকার শূন্যতার মধ্য দিয়ে পাপ ও মৃত্যু শয়তানের অনুসরণ করে চলতে থাকায় পথ অতিক্রম করতে দারুণ কষ্ট হচ্ছিল তার।
এমন সময় সহসা সোনায় শিকলবাঁধা সেই নূতন জগৎটা পরিদৃশ্য হয়ে উঠল শয়তানের চোখের সামনে। আকাশে সেটা নক্ষত্রের থেকে ছোট চন্দ্রের পাশে একটা গ্রহের মত দেখাচ্ছিল।
সেই জগতের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল শয়তানরাজ।
ঈশ্বর স্বর্গের সিংহাসনে সমাসীন অবস্থায় দেখলেন, শয়তান তাঁর নবনির্মিত পৃথিবীর দিকে উড়ে যাচ্ছে। তিনি তাঁর ডান পাশে বসে থাকা তাঁর মানসপুত্রকে তা দেখিয়ে বললেন, শয়তান মানবজাতির মনকে কলুষিত করে তাদের বশীভূত করে তুলবে। তিনি তাঁর ন্যায়পরায়ণতার কথা উল্লেখ করে বললেন, তিনি মানুষ সৃষ্টি করে তাকে স্বাধীন বিচারবুদ্ধি দান করেছেন যাতে সে যে কোন বাইরের প্রলোভনকে জয় করতে পারে। তবে যদি কোন কারণে মানবজাতির পন ঘটে তাহলেও তারা তার অনুগ্রহলাভে বঞ্চিত হবে না। কারণ এক্ষেত্রে যদি মানবজাতির পতন ঘটে তাহলে বুঝতে হবে তারা ঈশ্বরের প্রতি কোন হিংসা পোষণ করে না এবং এই হিংসা থেকে তাদের পতন ঘটেনি, তাদের পতন ঘটেছে শয়তানের প্ররোচনাতে।