সে আরও দেখল সেই দ্বারদেশের দুইদিকে দুজন ভয়ঙ্কর আকৃতির প্রহরী রয়েছে। একজন প্রহরীর কটিদেশ থেকে উপর পর্যন্ত সুন্দরী নারীমূর্তির আকৃতি, কিন্তু নিচের দিকটি সম্পূর্ণ বিষধর সাপের মত। যার দংশনমাত্রই মৃত্যু অনিবার্য। তার কটিদেশে ছিল এক নারকীয় কুকুরের মুখ। সে মুখ থেকে সব সময় ভয়ঙ্কর ঘেউ ঘেউ আওয়াজ বার হচ্ছিল।
অদ্ভুতদর্শন বিকটাকৃতি এই প্রহরীর থেকে সমুদ্ররাক্ষসী স্কাইল্লা কম ভয়ঙ্করী। নিয়ত শিশুর রক্তগন্ধবিশিষ্ট ল্যাপল্যান্ডের যে সব ডাইনিরা উজ্জ্বল চাঁদকে গ্রাস করে তারাও এর থেকে কম ঘৃণ্য ও কম জঘন্য।
অন্য প্রহরীটির মুখ বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কিছুই চেনা যাচ্ছিল না। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল রাত্রির অন্ধকারের মত ঘনকৃষ্ণ এক করাল ছায়ামূর্তি। শয়তানকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সেই ছায়ামূর্তি তার দিকে দর্পভরে বেগে ধাবিত হলো। তার পদভরে কম্পিত হয়ে উঠল সমগ্র নরকপ্রদেশ।
অপরাজেয় শয়তানরাজ সেই ছায়ামূর্তিকে দেখে ভয় পেল না বিন্দুমাত্র। সে ঘৃণাভরে ছায়ামূর্তির দিকে তাকিয়ে নির্ভীকভাবে বলতে লাগল, হে ঘৃণ্য আকৃতিবিশিষ্ট জীব, কে তুমি? কোথা হতে এসেছ? কেন তুমি এমন ভয়ঙ্করভাবে এগিয়ে এসে আমার গতিপথ রুদ্ধ করছ? আমি এই নরকদ্বার অতিক্রম করতে চাই। এ বিষয়ে আমি তোমার অনুমতির অপেক্ষা করি না। তুমি নরকজাত হয়ে স্বর্গের সন্তানের সঙ্গে বিবাদ করতে এস না।
তখন সেই ছায়ামূর্তি সরোষে বলল, তুমিই কি সেই বিশ্বাসঘাতক দেবদূত যে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে দর্পিত বিদ্রোহের দ্বারা প্রথম স্বর্গের শান্তি ও বিশ্বাস ভঙ্গ করে তৃতীয় জগৎবাসী স্বর্গের মানবসন্তানদের ঈশ্বরের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করো? আর এই অপরাধের জন্য তুমি ও তোমার দলের শয়তানরা ঈশ্বরের দ্বারা অভিশপ্ত হয়ে এই নরপ্রদেশে অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় অশেষ দুঃখ ও যন্ত্রণাময় জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়েছ। এক অভিশপ্ত ঘৃণ্য জীব হয়ে তুমি নিজেকে স্বর্গজাত সন্তান হিসাবে বড়াই করছ? যে আমি নরকপ্রদেশের বৈধ রাজা ও রক্ষক তাকে অমান্য ও ঘৃণা করে তুমি আবার নতুন করে তোমার প্রভু ও রাজাকে রুষ্ট করে তুলছ? যাও, যেমন শাস্তি ভোগ করছিলে তেমনি নীরবে শাস্তি ভোগ করগে। তা না হলে আমি বৃশ্চিক দংশনের মত জ্বালাময় চাবুক হাতে তুমি যেখানে যাবে আমি তোমাকে অনুসরণ করে যাব। হে ব্যর্থ পলাতক, অবিলম্বে চলে যাও এখান থেকে। তা যদি না যাও তাহলে তোমাকে ধরে এমনভাবে আঘাত করব যাতে অননুভূতপূর্ব যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে তোমায়।
এই কথা বলতে বলতে সেই ভয়ঙ্কর ছায়ামূর্তি তার আকারটাকে দশগুণ বর্ধিত করল। আগের থেকে আরও অনেক বেশি ভয়াবহ হয়ে উঠল সে।
অন্যদিকে এক ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠে এক জ্বলন্ত ধূমকেতুর মত নির্ভীকভাবে দাঁড়িয়ে রইল শয়তানরাজ।
মেরুপ্রদেশের আকাশে জ্বলতে থাকা যে ধূমকেতুর মাথার ভয়ঙ্কর কেশরাশি থেকে মহামারী, মড়ক আর যুদ্ধের বিভীষিকা ঝরে পড়ে সেই ধূমকেতু অথবা আকাশে যুদ্ধরত দুটি বজ্রগর্ভ মেঘের মত তাদের দুজনকে দেখাচ্ছিল তখন। কুটিকুটিল রোষকশায়িত লোচনে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তারা সামনাসামনি।– তাদের সেই ঐকুটিতে আরো বেড়ে গেল নরকের অন্ধকার। তাদের দুজনেরই মনে হলো তারা এমন ভয়ঙ্কর শত্রুর সম্মুখীন কখনো হয়নি জীবনে। তাদের দর্পিত পদভরে স্পর্ধিত আস্ফালনে মুহুর্মুহু কম্পিত হয়ে উঠেছিল নরকের সেই দ্বারদেশ।
এমন সময় সেই অর্ধনারী ও অর্ধনাগিনী অদ্ভুতদর্শনা মূর্তিটি ছুটে এসে দাঁড়াল তাদের মাঝখানে। সে শয়তানকে সম্বোধন করে বলল, হে পিতা, কেন তুমি তোমার একমাত্র পুত্রকে আঘাত করার জন্য হস্ত উত্তোলন করেছ? হে পুত্র, কোন্ সে ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তুমি তোমার পিতার উপর এমন মারাত্মক আঘাত হানতে চলেছ? কিন্তু জান কি কার জন্য একাজ করছ তুমি? তুমি তারই জন্য এই সব করছ যে স্বর্গলোকে বসে থেকে তোমাকে উপহাস করে চলে, যার বিধানে তুমি নরকের দ্বারী হয়ে আছ এবং যে তোমাকে নিয়ে তার খুশিমত যত সব হীন কাজ করিয়ে নেয়। যার রোষ একদিন তোমাদের দুজনকেই ধ্বংস করবে।
নরকের আবর্জনার মত ঝরে পড়া তার কথাগুলো সব বলা শেষ হলে শয়তানরাজ তাকে বলতে লাগল, তোমার চিৎকার এবং কথা এমনই অদ্ভুত যে আমি প্রতিনিবৃত্ত না হয়ে পারলাম না। তোমাকে দেখিয়ে দিতে পারলাম না আমি কি চাই।
কিন্তু আগে তোমার পরিচয় জানতে হবে। বল, কে তুমি এবং কেনই বা তুমি আমাকে তোমার পিতা আর ঐ প্রহরীকে আমার সন্তান বললে? তোমাকে আমি চিনি না। তোমার মত এমন ঘৃণ্য জীব কখনো দেখিনি আমি।
তখন সেই নারীনাগিনী দ্বারপালিকা বলল, তুমি কি আমাকে ভুলে গেছ? তোমার চোখে কি আমি এতই ঘৃণ্য? অথচ একদিন স্বর্গের রাজসভায় এবং তোমার ও তোমাদের মত যে সব দেবদূত স্বর্গের রাজার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তাদের সকলের চোখে আমি ছিলাম সুন্দরী। তারপর অকস্মাৎ একদিন দুঃখ ও যন্ত্রণার মধ্যে পতিত হয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাও তুমি। তোমার মাথা ঘুরতে থাকে। যখন অন্ধকারে জ্বলন্ত আগুনের মাঝে পড়ে যাও তখন বাঁ দিকে তোমারই মাথা থেকে স্বর্গীয় দ্যুতিসম্পন্ন এক দেবীমূর্তি বেরিয়ে আসে। আমি হলাম সেই দেবী।