এই কথা বলে শয়তানরাজ কারো কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই উঠে দাঁড়াল। পাছে তার কথা শুনে উপস্থিত বীরদের মধ্যে কেউ তার যাত্রাপথের সঙ্গী হবার জন্য এগিয়ে আসে তার জন্য আগে হতেই সে সে-পথ বন্ধ করে দিল। এক বিপুল পরিমাণ বিপদের ঝুঁকি নিয়ে যে বিরাট খ্যাতি ও গৌরব সে অর্জন করতে চলেছে, সে খ্যাতি ও গৌরবের অংশীদার হবার জন্য কেউ যাতে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে না পারে তার জন্য আগে হতে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করল সে।
কিন্তু উপস্থিত বীরদের কেউ কোন কথা বলতে সাহস পেল না। দুর্গম যাত্রাপথের ভয়াবহতার থেকে শয়তানরাজের এই নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত কণ্ঠস্বর আরও ভয়াবহ মনে হলো তাদের কাছে। বীরেরা সকলেই নীরবে উঠে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে দূরাগত বজ্রধ্বনির মত এক শব্দ উত্থিত হলো। তারা নত হয়ে ভয়ে ভয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করল তাদের রাজাকে। সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এক স্বর্গীয় দেবতার সম্মান তাকে দান করে তার গৌরবগান করল তারা। তাদের রাজা তাদের সকলের নিরাপত্তার জন্য নিজে কষ্ট স্বীকার করে যে বিপদসংকুল পথে যাত্রা করছে তার জন্য তার গুণগান করতেও ভুলল না। কারণ এই অভিশপ্ত অধঃপতিত আত্মারা সব গুণ হারায়নি। মর্ত্যের অনেক উচ্চাভিলাষী অহঙ্কারী ব্যক্তি অহঙ্কারে মত্ত হয়ে শুধু আপন কৃতিত্বের বড়াই করে চলে, অপরের গুণ বা যোগ্যতাকে স্বীকার করতে চায় না।
এইভাবে তাদের অতুলনীয় সর্বাধিনায়কের গুণগান ও আনন্দোল্লাসের মধ্য দিয়ে তাদের সকল সংশয়পূর্ণ আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটল। পর্বতের শিখরদেশ হতে সমুথিত ঘনকৃষ্ণ মেঘমালা যখন নীল আকাশকে আচ্ছন্ন করে তোলে ধীরে ধীরে, যখন দিন শেষের তুষার ও বৃষ্টিসিক্ত প্রান্তরের ঘনায়মান অন্ধকারের মধ্যে হিমশীতল বাতাস গর্জন করে বেড়ায় তখন যদি সহসা শেষ সূর্যরশ্মি ঝরে পড়ে সে প্রান্তরকে আলোকিত করে তোলে, তাহলে যেমন নীরব হয়ে যাওয়া পাখিরা আবার গান শুরু করে, গৃহাভিমুখী পশুর পাল আনন্দে চিৎকার করতে থাকে এবং পশুপাখির মিলিত কণ্ঠস্বর ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে থাকে পর্বত ও উপত্যকাদি মেনি এক উল্লসিত কলগুঞ্জনে ফেটে পড়ল সেই নরকনিবাসী শয়তানরা।
হায় মানুষ, তোমরা কত লজ্জার বস্তু! অভিশপ্ত শয়তানও শয়তানের সঙ্গে এক গভীর ঐক্যে আবদ্ধ হয়, কিন্তু মানুষ যুক্তিবাদী জীব হলেও ঐক্যবদ্ধ বা একমত হতে পারে না পরস্পরের সঙ্গে। যদিও তারা ঈশ্বরের অনুগ্রহ এবং শান্তিলাভের আশ্বাস পেয়েছে ঈশ্বরের কাছ থেকে তথাপি তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া, বিবাদ, হিংসা, শত্রুতা ও যুদ্ধবিগ্রহ করে দিন কাটায়। কিন্তু তারা জানে না তাদের নরকের শত্রুরা তাদের অলক্ষ্যে অগোচরে তাদের ধ্বংসের জন্য অপেক্ষা করছে দিনরাত। তা যদি তারা জানত তাহলে হয়ত তারা ঐক্যবদ্ধ হতে বাধ্য হত।
এইভাবে স্টাইজিয়াস্থিত নরকের সভার অবসান হলো। সমস্ত বীরেরা তাদের মুকুটমণি নরকের সম্রাটকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে এল সভাস্থল থেকে। এই স্বর্গদ্রোহী নরকসম্রাট ছিল রাজকীয় ঐশ্বর্যে ঈশ্বরেরই সমতুল। উজ্জ্বল অস্ত্রসম্ভার হাতে বীর সৈন্যরূপী অধঃপতিত দেবদূতেরা তাকে ঘিরে দাঁড়াল। তারপর জয়ঢাক বাজিয়ে সভার ফল রাজকীয় ঘোষণা হিসাবে ঘোষণা করল। বাদ্যসহযোগে সেই ঘোষণার কর্ণবিদারক শব্দ বিশাল নরকগহ্বরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
এইভাবে মনের দিক থেকে কিছুটা শান্ত হয়ে ও এক অর্থহীন উদ্ধত আশায় উদ্দীপিত হয়ে তারা সকলে আপন পথে চলে গেল। আপন আপন ইচ্ছানুসারে এক একটি জায়গায় বসে যত সব দুশ্চিন্তার কবল থেকে মুক্ত হয়ে তাদের প্রধান ফিরে না আসা পর্যন্ত এক স্তব্ধ প্রতীক্ষায় প্রহর গণনা করতে থাকবে তারা।
কিন্তু নিজেদের শোচনীয় দুরবস্থার কথা ভেবে এক জায়গায় বিশ্রাম করতে পারল না তারা। দলবদ্ধভাবে ভয়ে কম্পমান কলেবরে, ক্রোধে বিঘূর্ণিত চোখ নিয়ে ম্লান মুখে বহু তুষারাচ্ছন্ন হিমশীতল পর্বত ও উত্তপ্ত উপত্যকা পার হয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে লাগল তারা।
তারা দেখল ঈশ্বরের দ্বারা শাপগ্রস্ত হয়ে যে নরকপ্রদেশে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, সে নরকপ্রদেশ স্বর্গের তুলনায় বড় হীন এবং বসবাসের অযোগ্য।
সে জগৎ মৃত্যুর রাজ্য। সেখানে জীবন্ত মৃত্যু এক অপরিহার্য ভয়াবহতায় সতত বিরাজ করে সর্বত্র। সেখানে প্রকৃতিদৃষ্ট অনেক অতিকায় দানবাকৃতি ভয়ঙ্কর জীবজন্তু মৃত্যুর দূতরূপে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায় এখানে সেখানে।
এদিকে তখন ঈশ্বরদ্রোহী শয়তানরাজ পাখা মেলে ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে নরকপ্রদেশের সীমানা অতিক্রম করার জন্য নরকদ্বারের দিকে কখনো বাঁ দিকে কখনো ডান দিকে উড়ে চলেছে।
ঊর্ধ্বে উৎক্রমণ করতে করতে এক দুর্ভেদ্য ছাদের কাছে এসে পড়ল শয়তানরাজ। দেখল আর সে উপরে উঠতে পারবে না। সে ছাদ ভেদ করে তার বাইরে যেতে পারবে না। তাকে নরকপ্রদেশের সীমানা পার হতে হলে নরকদ্বারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
অবশেষে নরকদ্বারের কাছে এসে উপনীত হলো সে। দেখল তিনটি রুদ্ধ দরজা দ্বারা সে দ্বারদেশ-সুরক্ষিত। একটি দরজা পিতলের এবং একটি কঠিন পাথরের দ্বারা নির্মিত। চক্রাকার অগ্নিকুণ্ডের দ্বারা পরিবৃত সে দ্বারদেশ সে অগ্নিকুণ্ড জ্বলন্ত হলেও কিছুই দন্ধ হচ্ছে না তার দ্বারা।