হয় আমরা সে জগৎকে নারকীয় অগ্নিকাণ্ডের দ্বারা বিধ্বস্ত করব সম্পূর্ণরূপে, আমরা যেমন বিতাড়িত হয়েছি স্বর্গরাজ্য হতে তেমনি মানবজাতিকেও বিতাড়িত করব তাদের জগৎ থেকে, অথবা যদি বিতাড়িত না করি তাহলে তাদের বশীভূত করে দলভুক্ত করব আমাদের যাতে ঈশ্বর নিজেই শত্রু হয়ে দাঁড়ায় তার সৃষ্ট প্রিয় মানবজাতির উপর এবং নিজের সৃষ্টিকে নিজেই নস্যাৎ করতে বাধ্য হয়।
সাধারণ প্রতিশোধগ্রহণ থেকে এ পথ অনেক ভাল। এতে আমাদের আনন্দ বর্ধিত হবে আর ঈশ্বরের আনন্দ ব্যাহত হবে। তার মানবসন্তানরা তাদের বাস্তু থেকে বিচ্যুত হয়ে আমাদের দলে যোগদান করতে বাধ্য হবে এবং তখন তারা সব সুখ হারিয়ে তাদের স্রষ্টাকে অভিশাপ দেবে। এখন আলোচনা করে দেখ, এই পথ অনুসরণের যোগ্য কিনা, অথবা এখানে অন্ধকারে বসে বসে স্বরাজ্য স্থাপনের ব্যর্থ পরিকল্পনা খাড়া করে চল।
এইভাবে বীলজীবাব তার শয়তানী পরামর্শ দান করল।
এই পরিকল্পনা শয়তানরাজ স্বয়ং খাড়া করে এক গভীর ঘৃণার বশবর্তী হয়ে মানবজাতিকে উচ্ছেদ করে মর্ত্য ও নরককে এক করে মিশিয়ে দিতে চায় এবং পরম স্রষ্টাকে অপমানিত করে তার গৌরবকে খর্ব করতে চায়।
কিন্তু তাদের এই ঘৃণা আর বিদ্বেষ সত্ত্বেও ঈশ্বরের গৌরব বেড়ে যেতে থাকে।
এদিকে বীলজীবাবের দুঃসাহসিক পরিকল্পনার কথা শুনে নরকের সবাই আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠল। সে আনন্দের উজ্জ্বলতা এক একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গর মত উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তাদের চোখে। তারা পূর্ণ সমর্থন জানাল এ পরিকল্পনাকে।
বীলজীবাব তখন আবার বলতে লাগল, তোমরা ঠিকই রায় দিয়ে এক দীর্ঘ বিতর্কের অবসান ঘটালে, এক বিরাট সমস্যার সমাধান করলে। একমাত্র এই পরিকল্পনার সার্থক রূপায়ণই আমাদের দুর্ভাগ্য সত্ত্বেও এই গভীর নরকগহ্বর হতে আমাদের উত্তোলিত করে আমাদের পুরাতন বাসস্থানের নিকটে নিয়ে যাবে। সেখান থেকে হয়ত আমরা নতুন করে শক্তি সংগ্রহ করে উপযুক্ত সুযোগ বুঝে এক সামরিক অভিযানের দ্বারা স্বর্গলোকে পুনরায় প্রবেশ করব। আমরা স্বর্গের নিকটবর্তী এমন এক ভালো জায়গায় বসতি স্থাপন করব যে জায়গা স্বর্গের উজ্জ্বল আলোর দ্বারা আলোকিত, যে জায়গা নরকপ্রদেশের এই অন্ধকার হতে মুক্ত। সেখানকার শীতল বাতাস এই নরকাগ্নি দ্বারা দগ্ধ আমাদের দেহের ক্ষতগুলিকে শান্তির প্রলেপ দিয়ে সারিয়ে তুলবে।
কিন্তু সেই নতুন জগতের সন্ধানে কাকে আমরা পাঠাব? কাকে আমরা এ কাজের যোগ্য হিসাবে মনোনীত করব? কে আমাদের মধ্যে পায়ে হেঁটে পথ খুঁজে অথবা অক্লান্ত উদ্ধত পাখায় ভর করে আকাশপথে উড়ে যাবে সেই সুখের রাজ্যে? কার এমন শক্তি আছে যে শক্তির দ্বারা কৌশলে দেবদূতদের কঠোর প্রহরা এড়িয়ে গন্তব্যস্থলে উপনীত হতে পারবে? এজন্য তার চাই সার্বিক পর্যবেক্ষণশক্তি। আমাদের নির্বাচনও যেন ত্রুটিহীন হয়। কারণ যে ব্যক্তিকে আমরা পাঠাব তারই উপর নির্ভর করছে আমাদের পরিকল্পনার সকল গুরুত্ব এবং শেষ আশার সাফল্য।
এই কথা বলে বসে পড়ল বীলজীবাব। এরপর কে দাঁড়িয়ে তাকে সমর্থন করে অথবা প্রতিবাদ করে তা দেখার জন্য এক প্রত্যাশা ও উদ্বেগের আবেগ ফুটে উঠেছিল তার চোখে। তার প্রস্তাবিত তৃতীয় জগতের সন্ধানে, এক বিপজ্জনক যাত্রায় বার হতে কেউ এগিয়ে আসে কিনা তা দেখতে চাইছিল সে।
কিন্তু কেউ উঠে দাঁড়াল না। সকলেই নীরব নির্বাক হয়ে বসে রইল। এই পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিপদের কথা গভীরভাবে ভাবতে লাগল সবাই। প্রত্যেকেই বিস্ময়ের সঙ্গে প্রত্যেকের চোখে তার আপন আপন আশঙ্কার প্রতিফলন দেখল।
যে সব বীরেরা কিছুক্ষণ আগে স্বর্গের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে যাচ্ছিল তাদের কেউ এগিয়ে এসে সাহসের সঙ্গে এই ভয়ঙ্কর যাত্রা শুরু করতে চাইল না।
অবশেষে যার গৌরব ছিল সকলের ঊর্ধ্বে, এক রাজকীয় গর্বের বশবর্তী হয়ে যে নিজেকে সবচেয়ে যোগ্য বলে মনে করত সেই শয়তানরাজ অবিচলিতভাবে বলতে লাগল,
হে স্বর্গের সন্তানগণ, তোমরা যুক্তিসঙ্গতভাবেই যৌন হয়ে থাকলেও ভীত হয়ে পড়নি তোমরা। যে পথ এই নরকপ্রদেশ হতে আলোকের দিকে ঊর্ধ্বে উঠে গেছে সে পথ দীর্ঘ এবং শ্রমসাধ্য। সর্বগ্রাসী লেলিহান শিখাসমন্বিত বিশাল অগ্নিকুণ্ড আমাদের কারাগারটিকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। এখান থেকে বার হবার সব পথ রুদ্ধ। যদি কেউ জ্বলন্ত অগ্নিপূর্ণ এই কারাগার অতিক্রম করতে পারে তাহলেই সে জনপ্রাণীহীন ভীতিপ্রদ এক গভীর অন্ধকারের বিশাল ব্যাপ্তির মধ্যে নিমজ্জিত হবে। সেই অন্ধকারের রাজ্য থেকে সে যদি কোনরকমে একবার কোন এক অজানা জগতে প্রবেশ করতে পারে তাহলে সে এমন কি বিপদের সম্মুখীন হবে যা সে অতিক্রম করতে পারবে না? কিন্তু এই রাজসিংহাসন, সার্বভৌম শক্তি, ঐশ্বর্য ও অস্ত্রসম্ভারের অধিকারী হয়েও আমি যদি এই বিপদ ও শ্রমসংকুল যাত্রাপথে অগ্রসর না হই তাহলে বৃথাই আমাদের এই ক্ষমতা ও মর্যাদালাভ। যে দুঃসাহসিক কর্মের মধ্যে বিপদ এবং সম্মান দুইই আছে সে কর্মসম্পাদনে যদি আমি সচেষ্ট না হই তাহলে কেন আমি এই রাজক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আছি? কেন আমি তাহলে এই সিংহাসন ত্যাগ করছি না?
আমাদের ঊর্ধ্বে যে স্বর্গের অধিপতি হয়ে বসে আছে তাকে তো আরও কত বড় বিপদের সম্মুখীন হতে হয়। হে স্বর্গত্রাস শক্তিশালী বীরগণ, তোমরা অধঃপতিত হলেও শক্তিহীন নও। আমি যখন দূরে গিয়ে সর্বগ্রাসী এক বিশালব্যাপ্ত অন্ধকারের মধ্যে আমাদের সকলের জন্য মুক্তির সন্ধানে ব্যাপৃত থাকব তখন প্রতিকারের আশা তোমাদের এই দুঃসহ আবাসভূমিটিকে সহনীয় ও তোমাদের নরকযন্ত্রণাকে কিছুটা প্রশমিত করে তুললেও আমাদের সদাজাগ্রত শত্রুর প্রতি তোমাদের কড়া দৃষ্টির প্রহরাকে যেন কিছুমাত্র শিথিল করো না। আমার এই যাত্রায় আর কাউকে সঙ্গী হতে হবে না।