ম্যামনের কথা শেষ হতে না হতেই এক প্রবল কলগুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠল সমগ্র সভাস্থল। যে সামুদ্রিক ঝড় সারারাত ধরে সমুদ্রকে বিক্ষুব্ধ করে সমুদ্রনাবিকদের ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলে তাদের কোন পর্বতসংকুল উপসাগরে নোঙর করতে বাধ্য করে, সে ঝড়ের গর্জনে শূন্য পর্বতপ্রদেশ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হলে যে শব্দ উত্থিত হয়, সেই ধরনের শব্দে কম্পিত হয়ে উঠল শয়তানের নারকীয় সভাস্থল।
ম্যামনের কথা শেষ হতেই তার শান্তির পরামর্শ শুনে বিপুল হর্ষধ্বনি উঠল সভায়। শ্রোতারা সন্তুষ্ট হলো তার কথায়। কারণ যুদ্ধের বিভীষিকাকে, নরকযন্ত্রণাকে ভয় করছিল তারা। বজ্র আর মাইকেলের তরবারির ভয়ের দ্বারা তখনো পীড়িত হচ্ছিল তাদের মন। তার উপর এই নরকপ্রদেশে এমন এক সাম্রাজ্য স্থাপন করার আশায় উদ্দীপিত হয়ে উঠেছিল তাদের মন যে সাম্রাজ্য কালক্রমে তাদের দৃঢ় নীতি, শ্রম ও সাধনার দ্বারা স্বর্গরাজ্যের অনুরূপ মাহাত্ম্য ও মর্যাদা লাভ করবে।
এরপর সব কিছু দেখে শুনে বীলজীবাব উঠে দাঁড়াল। মর্যাদার দিক থেকে তাদের নেতা শয়তানের পরেই ছিল তার স্থান। তার চেহারাটা যেমন ছিল এক স্তম্ভের মতই বিশাল এবং গম্ভীর, তার মুখমণ্ডলের উপর তেমনি ছিল আলোচনার এক গভীর আগ্রহ এবং উদ্বেগ। এক শোচনীয় সর্বনাশের মধ্যেও তার মুখে ছিল এক রাজকীয় মর্যাদার ভাব। তার দৃঢ় ও উন্নত স্কন্ধদ্বয় বহু শক্তিশালী রাজ্যভার বহনের উপযুক্ত।
বীলজীবাবের রাত্রির মত গম্ভীর কণ্ঠস্বর উপস্থিত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সকলের মনোযোগ নিবদ্ধ হলো তার উপর। সে বলতে আরম্ভ করল,
সিংহাসন, সাম্রাজ্য, রাজকীয় শক্তি, স্বর্গের সন্তান, স্বর্গীয় গুণাবলী-আজ আমাদের এই সমস্ত উপাধি ত্যাগ করে নিজেদের কি নরকের রাজা হিসাবে অভিহিত করব আমরা? আমাদের এখানকার সকলে এখানে এক সাম্রাজ্য স্থাপনের পক্ষেই রায় দিয়েছে। কিন্তু যখন আমরা এই স্বপ্ন দেখছি তখন আমরা একথা ভেবে দেখছি না যে স্বর্গলোকের রাজা আমাদের এখানে কারারুদ্ধ করে রেখেছেন। এই নরকপ্রদেশ আমাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল নয়, আসলে এটি হলো আমাদের কারাগার। মনে রাখবে, এই নরকপ্রদেশও তার শাসন ও প্রভুত্বাধীন এলাকার বাইরে নয়। স্বর্গলোক হতে যত দূরেই হোক, এখানে আমাদের তারই কঠোর শাসনাধীনে বন্দী হয়ে থাকতে হবে।
একথা নিশ্চিত যে, স্বর্গে ও নরকে সে-ই একমাত্র সার্বভৌম রাজারূপে রাজত্ব করে থাকে অনন্তকাল ধরে এবং আমরা যতই বিপন্ন বা বিদ্রোহ করি না কেন, সে তার দুলোক ও ভূলোকব্যাপী বিশাল সাম্রাজ্যের কোন অংশ ছাড়তে চাইবে না। বরং সে তার সাম্রাজ্য এই নরকপ্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত করে কঠোরভাবে শাসন করবে আমাদের।
তাহলে আমরা বসে বসে শান্তি আর যুদ্ধের কথা আলোচনা করছি কেন? আমরা যদি যুদ্ধ করার সংকল্প করি তাহলে অপূরণীয় ক্ষয়-ক্ষতির ঝুঁকি নিতে হবে, আর যদি শান্তি বা সন্ধি স্থাপন করি তাহলে সে সন্ধির সুফল সম্বন্ধে কোন প্রতিশ্রুতি পাব না আমরা। আমাদের যদি দাসত্বের বন্ধনে আবদ্ধ থাকতেই হয় তাহলে কোন্ শান্তি পাব আমরা? শান্তির পরিবর্তে শুধু এক কঠোর স্বৈরাচারী শাসন আর শান্তি আরোপিত হবে আমাদের উপর বলপ্রয়োগের দ্বারা।
শুধু তাই নয়, আমরা আমাদের বিজেতা শক্তিকেও কোন শাস্তি দিতে পারব না। তার পরিবর্তে সে শক্তি আমাদের কাছ থেকে পাবে শুধু এক অপরিসীম বিদ্বেষ, ঘৃণা, দুর্দমনীয় বিতৃষ্ণা আর প্রতিহিংসার তীব্রতা। যতই আমরা যত সব অত্যাচার, অবিচার এবং নির্যাতন সহ্য করে যাব ততই আমরা ধীরে ধীরে বিজেতা শক্তির বিরুদ্ধে এক প্রতিশোধাত্মক ষড়যন্ত্রের জাল বুনে যাব। দেখব সে শক্তি আমাদের নির্যাতিত করে কত আনন্দ লাভ করে।
সে ক্ষেত্রে আমাদের সুযোগেরও হয়ত অভাব হবে না। হয়ত আমরা এক বিপজ্জনক অভিযানে তৎপর হয়ে স্বর্গলোক আক্রমণ করব। যে স্বর্গরাজ্যের সুউচ্চ প্রাসাদগুলি সুদুর নরকপ্রদেশ হতে কোন আক্রমণ, অবরোধ বা অভিযান আশঙ্কা করে না কখনো, সেই স্বর্গরাজ্য হয়ত আক্রান্ত হবে আমাদের দ্বারা।
এক্ষেত্রে দেখতে হবে আমরা এ বিষয়ে সহজতর উপায় খুঁজে পাই কিনা। স্বর্গ আর পাতালপ্রদেশের মাঝখানে আর এক তৃতীয় জগৎ আছে যেখানে মানবজাতি নামে এক নতুন জাতি বাস করে সুখে-শান্তিতে। এতদিনে হয়ত সে মানবজাতি সৃষ্ট হয়েছে। তারা দেখতে অনেকটা আমাদের মত। শুধু শক্তি-সামর্থ্য ও বীরত্বের দিক থেকে অনেক নিকৃষ্ট আমাদের থেকে। কিন্তু স্বর্গের অধিপতির বড় প্রিয় তারা এবং স্বর্গাধিপতি নিজে মানবজাতির প্রতি তার অনুগ্রহের কথা দেবতাদের কাছে ঘোষণা করে সদর্পে।
সেই মানবজাতির কথা আমাদের একবার ভাবা উচিত। তাদের দিকে একবার দৃষ্টি দেওয়া উচিত। আমাদের জানা উচিত সেই তৃতীয় জগতে কি ধরনের প্রাণী বাস করে, জানা দরকার কতখানি শক্তি ধারণ করে তারা। কি কি গুণাবলীর দ্বারা তারা ভূষিত এবং তাদের দুর্বলতাই বা কি। দেখতে হবে বলপ্রয়োেগ বা সূক্ষ্ম কৌশলের দ্বারা কিভাবে বশে আনতে পারা যাবে তাদের।
যদিও স্বর্গের দ্বার চিরতরে বন্ধ আমাদের কাছে এবং স্বর্গের সার্বভৌম অধিপতি। আপন শক্তিতে অধিষ্ঠিত আছেন নিরাপদে, তথাপি সেই বিরাট জগৎ হয়ত দুরধিগম্য নয় আমাদের কাছে। সে জগৎ স্বর্গরাজ্যের শেষ প্রান্তে অবস্থিত এবং তা হতে তার অধিবাসীরা বঞ্চিত। সে জগৎ যদি আমরা অকস্মাৎ আক্রমণ করি তাহলে হয়ত আমাদের কিছু সুবিধা হতে পারে।