তিনি পরম করুণাময়। তাঁর করুণায় সমস্ত অশুভ শক্তিকে জয় করে মঙ্গল লাভ করা যায়। যারা আপাতদৃষ্টিতে ক্ষুদ্র ও দুর্বল তারাও তার করুণা ও অনুগ্রহের ফলে পার্থিব শক্তিতে বলবানদের বশীভূত করতে পারে। সত্যের খাতিরে দুঃখভোগের মধ্য দিয়ে জয়ের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করতে পারা যায়। ঈশ্বরবিশ্বাসীদের কাছে মৃত্যুও নবজীবনের দ্বার খুলে দেয়। যাঁকে আমি আমার পরম পরিত্রাতা মনে করি তাঁর দৃষ্টান্ত থেকেই এ শিক্ষা লাভ করেছি।
তখন মাইকেল শেষবারের মতো বলল, এই কথা জেনে তুমি সমস্ত ধর্মের সারমর্ম জেনে ফেলেছ। এক বৃহত্তর জীবনের আশায় অনুপ্রাণিত হবে তুমি। সব নক্ষত্রদের নাম, স্বর্গে ঈশ্বরের সব কর্মপদ্ধতি, ঐশ্বরিক শক্তির সব রহস্য, জলে স্থলে অন্তরীক্ষে প্রকৃতির সব কাজকর্ম, জগতের সব রাজ্য ও সাম্রাজ্যের শাসনপদ্ধতি ও ধনসম্পদের রহস্য সব জানতে পারবে তুমি।
এইভাবে সব জ্ঞাতব্য বিষয় জানতে পেরে তোমার জ্ঞান বেড়ে যাবে। তার ফলে তোমার ধর্মবিশ্বাস, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, প্রেম, ভালবাসা প্রভৃতি গুণগুলিও বেড়ে যাবে। তখন তুমি এই স্বর্গোদ্যান ছেড়ে আর দুঃখবোধ করবে না। তোমার মনই এক মনোরম স্বর্গোদ্যান হয়ে উঠবে। তুমি আগের থেকে আরও অনেক সুখী হবে। সকল গুণের শ্রেষ্ঠ প্রেম তোমাদের বদান্যতা ও সাবলীলতার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হবে। এখন এই কল্পনার শিখরদেশ এই মর্ত্য থেকে নেমে চল। এখন আমাদের যাওয়ার সময় হয়েছে। ঐ দেখ, নিকটবর্তী এক পাহাড়ে অবস্থিত শিবির থেকে দেবদূত প্রহরীরা একটি জ্বলন্ত তরবারি ঘুরিয়ে ফিরে যাওয়ার সংকেত দান করছে। আর আমরা এখানে একমুহূর্তও থাকতে পারি না।
যাও, ঈভকে গিয়ে জাগাও। এক মধুর স্বপ্ন দিয়ে শান্ত করে রেখেছি তাকে। সে স্বপ্নে অনেক সুলক্ষণ দেখতে পাবে। এক অকুণ্ঠ আত্মসমর্পণে দৃঢ়সংকল্প হয়ে উঠবে তার অন্তরাত্মা। তুমি সময় বুঝে যা যা আমার কাছে শুনেছ তা সব বলবে তাকে, বিশেষ করে তার ধর্মবিশ্বাস দৃঢ় করার জন্য যা তার জানা দরকার। বলবে মানবজাতির পরম মুক্তিদাতা তারই গর্ভজাত এক সন্তানরূপে জন্মগ্রহণ করবে।
বলবে, তুমি দীর্ঘকাল বাঁচবে। দুঃখের দিন সব পার হয়ে গেছে। ধর্ম অবলম্বন করে উপাসনার দ্বারা সুখে জীবন অতিবাহিত করবে তুমি।
মাইকেলের কথা শেষ হতেই পাহাড় থেকে অবতরণ করতে লাগল তারা।
পাহাড়ের পাদদেশে নেমে এসেই আদম সেই কুঞ্জবনে ছুটে গেল যেখানে ঈভ ঘুমিয়ে ছিল। কিন্তু গিয়ে দেখল, ঈভ আগেই জেগে উঠেছে ঘুম থেকে।
ঈভ তখন উৎফুল্লভাবে আদমকে বলল, কোথায় গিয়েছিলে, কোথা হতে ফিরে এলে তুমি তা আমি জানি। কারণ ঈশ্বর নিদ্রা ও স্বপ্নের সময়ে মানুষের আত্মার মধ্যেই বিরাজ করেন। গভীর বিষাদ ও দুঃখের ভারে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমি। কিন্তু তিনি আমার সেই ঘুমের মধ্যেই কয়েকটি সুলক্ষণের দ্বারা আমাদের ভবিষ্যৎ সুদিনের কথা বলে দিয়েছেন।
এখন চল কোথায় যাবে। তোমার সঙ্গে যেকোন স্থানে যাওয়া আর এখানে থাকা সমান কথা। তোমাকে ছেড়ে এখানে থাকা মানে আমার আত্মাহীন ইচ্ছাহীন দেহের অবস্থানমাত্র। তুমি আমারই অপরাধের জন্য নির্বাসিত হয়েছ এখান থেকে। এখন তুমি আমার সব, স্বর্গ-মর্ত্যের সব স্থান তোমার মধ্যেই আছে।
এখন একটা সান্ত্বনা নিয়ে শান্ত মনে যাচ্ছি এখান থেকে। আমি সব কিছু হারালেও আমি শত অযোগ্য হলেও ঈশ্বরের একটি মহতী অনুগ্রহতে ধন্য হয়েছি, আমারই গর্ভজাত সন্তান অধঃপতিত মানবজাতিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবে তার হারানো গৌরবের মধ্যে।
আমাদের আদিমাতা এই কথা বললে আদম তা শুনে সন্তুষ্ট হলো। কিন্তু কোন কথা বলল না। কারণ প্রধান দেবদূত মাইকেল প্রহরীদের সঙ্গে নিকটেই অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। তারা সবাই পাহাড় থেকে নামছিল। তাদের সামনে সেই জ্বলন্ত তরবারিটি জ্বলন্ত উল্কার মতো তাদের আগে আগে যাচ্ছিল।
মাইকেল এবার আদম ও ঈভকে দুহাতে ধরে স্বর্গলোকের পূর্বদ্বারে নিয়ে গেল। তারপর সেই খাড়াই পাহাড়ের প্রান্তভাগ থেকে নীচের এক সমতলভূমিতে তাদের নামিয়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আদম ও ঈভ একবার পিছন ফিরে তাকিয়ে তাদের এতদিনের বাসভূমি সেই স্বর্গোদ্যানের পূর্বদিকটি দেখল। এখন সেই দ্বারপথটিকে ভয়ঙ্কর আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দেবদূত প্রহরীরা পাহারা দিচ্ছে।
স্বতঃস্ফূর্ত কয়েক বিন্দু অশ্রু ঝড়ে পড়ল তাদের চোখ থেকে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তা মুছে ফেলল তারা। তারা দেখল তাদের সামনে প্রসারিত হয়ে আছে অনন্ত পৃথিবী। কোন্ স্থানটিকে তাদের আবাসভূমি হিসাবে বেছে নেবে, কিভাবে ঐশ্বরিক বিধান তাদের পথ প্রদর্শন করবে তা ভাবতে লাগল তারা। তারপর দুজনে হাত ধরাধরি করে ধীর গতিতে এগিয়ে চলতে লাগল জনমানবহীন পৃথিবীর পথে।