এখন বল, আমাদের পরম পরিত্রাতা স্বর্গারোহণ করলে তার অল্পসংখ্যক বিশ্বস্ত অনুগামীরা অবিশ্বাসী নাস্তিকদের মধ্যে কি করবে? তাদের ভাগ্যে কি ঘটবে? সত্যের শত্ৰু সেই সব ঈশ্বরদ্রোহীদের কবল থেকে কে তাদের রক্ষা করবে? সেই সব অবিশ্বাসীরা ঈশ্বরপুত্রের সঙ্গে যে ব্যবহার করেছিল, তার অনুগামীদের সঙ্গে কি তার থেকে খারাপ ব্যবহার করবে না?
তখন দেবদূত প্রধান মাইকেল বলল, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই করবে। স্বর্গ থেকে ঈশ্বর একজন উদ্ধারকর্তাকে পাঠাবেন। পরমপিতার এক উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি বহন করে আনবেন তিনি। তিনি তাদের মধ্যে তাদের অন্তরাত্মারূপে বাস করবেন। ঈশ্বরপ্রেমের মধ্য দিয়ে ঈশ্বরবিশ্বাস কিভাবে কাজ করে তার বিধানগুলি তিনি মুদ্রিত করে দেবেন তাদের অন্তরে। তিনি তাদের ন্যায় ও সত্যের পথ দেখাবেন। তিনি তাদের এমন এক আধ্যাত্মিক শক্তি দান করবেন যে শক্তি দিয়ে তারা শয়তানদের সব আক্রমণকে প্রতিহত করতে পারবে, তার সব অগ্নিগর্ভ শরগুলিকে ব্যর্থ করে দিতে পারবে। মানুষ তখন নির্ভীক চিত্তে তাদের আত্মশক্তির দ্বারা সব নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে এমনভাবে রুখে দাঁড়াবে যে তা দেখে সেই সব গর্বোদ্ধত অত্যাচারীরাও আশ্চর্য হয়ে যাবে।
ঈশ্বর প্রথমে কয়েকজন সাধুপুরুষকে মানবজাতির মধ্যে তার বাণী প্রচারের জন্য পাঠাবেন। তারপর যারা তাঁর ধর্মে দীক্ষিত হবে তাদের এমন এক আশ্চর্যজনক শক্তি দান করবেন যার দ্বারা তারা সকল জাতির মানুষের সঙ্গে সকল ভাষায় কথা বলে ধর্মবোধে অনুপ্রাণিত করতে পারবে সকলকে। অনেক অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারবে।
এইভাবে তারা প্রতিটি জাতির মধ্যে বহুসংখ্যক মানুষের হৃদয় জয় করতে পারবে যারা স্বর্গ থেকে আগত ঈশ্বরের বাণী আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করবে।
অবশেষে সেই ধর্মপ্রচারকেরা তাদের কাজ শেষ করে তাদের নীতি উপদেশ সমম্বিত ধর্মবাণীগুলিকে লিপিবদ্ধ করে মহাপ্রয়াণ করবেন। তারা আগে থেকে সাবধান করে দিয়ে যাবেন, তাদের মৃত্যুর পর যত সব নরখাদক ভয়ঙ্কর নেকড়ের দল ধর্মপ্রচারকের আসনে এসে বসবে যারা ঈশ্বরের পবিত্র বাণী ও নীতি উপদেশগুলিকে নিজেদের অসংযত উচ্চাভিলাষ ও স্বাহপূরণের উপায় হিসাবে ব্যবহার করবে। সত্যের সঙ্গে কুসংস্কার ও প্রথাগত ক্রিয়াকাণ্ডগুলিকে মিলিয়ে ধর্মের মূল সত্যকে কলুষিত করে তুলবে তারা। সে সত্য শুধু বিশুদ্ধ অবস্থায় গ্রন্থে লিপিবদ্ধ থাকবে। অন্তর দিয়ে সে সত্য কেউ বুঝতে চেষ্টা করবে না।
তারপর সেই সব স্বার্থান্ধ ধর্মপ্রচারকেরা আধ্যাত্মিকতার ভান করে রাজক্ষমতা লাভ করবে। তখন তারা নিজেদেরই ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে ধর্মবিশ্বাসীদের প্রভাবিত করে তাদের বড় বড় মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবে। ফলে সেই সব বিধান তাদের অন্তরাত্মা গ্রহণ করতে পারবে না।
এইভাবে মানবাত্মার উপর জোর করে ঈশ্বরের বাণী চাপিয়ে দিয়ে ঈশ্বরের মহিমাকে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতার সঙ্গে এক নিষ্ঠুর বন্ধনে আবদ্ধ করবে তারা। ফলে অন্তরের স্বতঃস্ফূর্ত বিশ্বাস ও প্রেমভক্তির ভিত্তিভূমির উপর ঈশ্বরের যে মন্দির স্থাপিত হয় সে মন্দিরের মহিমাকে ধূলায় লুটিয়ে দেবে তারা। যে মানুষের পৃথিবীতে ঈশ্বরের এক একটি জীবন্ত মন্দির তাদের স্বাধীনতা হরণ করে তাদের মধ্যে প্রভূত ধর্মবিশ্বাস জাগাতে পারবে সে মন্দির ধ্বংস করে দেবে তারা। সেই সঙ্গে নিজেদের ধর্মবিশ্বাসও হারিয়ে ফেলবে। যার নিজের মধ্যে কোন ধর্মবিশ্বাস নেই তার মুখে ধর্মের কথা কেন শুনবে লোকে? কি করে তাকে অভ্রান্ত বলে মনে করতে পারবে?
অবশ্য অনেকেই তা মেনে চলবে। ফলে যারা ধর্মোপাসনার মধ্যে ধর্মের সত্য ও মর্মার্থ উপলব্ধি করার চেষ্টা করবে তাদের উপর জোর অত্যাচার শুরু হবে। কারণ বেশির ভাগ মানুষ তখন বাইরের আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মের দ্বারাই তাদের ধর্মবোধকে তৃপ্ত করবে। সেই সব নীরস কর্মের মধ্যেই ধর্মের সত্যকে সীমাবদ্ধ দেখে তৃপ্ত হবে। নিন্দার ভয়ে সত্য মুখ লুকোবে, প্রকৃত ধর্মবিশ্বাস কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এইভাবে জগৎ চলবে মন্দ ও অশুভ শক্তির হাতে পড়ে, যা কিছু শুভ ও সত্য তা যন্ত্রণায় আর্তনাদ করবে। অবশেষে দুষ্ট ও দুবৃত্তদের উপর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য আবার তিনি ফিরে আসবেন নারীর গর্ভজাত সন্তানরূপে। একথা আগেই দুর্বোধ্যভাবে বলা হয়েছিল।’
তোমার পরিত্রাতা এবং প্রভু সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পেরেছ। অবশেষে তিনি স্বর্গ থেকে মেঘের আবরণে নিজেকে আবৃত করে পৃথিবীতে এসে পরম পিতার গৌরব ও মহিমা প্রকাশ করবেন। শয়তান ও তার বিকৃত জগৎকে ধ্বংস করে দেবেন। মানুষের চিত্তকে শোধন করে অক্ষয় শান্তি ও ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তির উপর এক নূতন স্বর্গ ও পৃথিবী গড়ে তুলবেন। সে পৃথিবীতে অনন্তকাল ধরে অবিচ্ছিন্নভাবে পরিপূর্ণ আনন্দ ও এক পরম স্বর্গীয় সুখ বিরাজ করতে থাকবে।
মাইকেলের কথা এইখানে শেষ হলে আদম বলল, হেসত্যদ্রষ্টা, তোমার ভবিষ্যৎবাণী কত শীঘ্র দ্রুতগতি কালের মতো ধাবমান হয়ে সমগ্র জগৎ পরিক্রমা করে এল। তার বাইরেই বিরাট শূন্যতার এক খাদ। যার অনন্ত অতল গভীরতা চোখে দেখা যায় না।
আমি অনেক উপদেশ অনেক শিক্ষা লাভ করেছি। আমি এবার শান্ত মনে নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যাব এখান থেকে। আমি প্রচুর জ্ঞান লাভ করে তৃপ্ত হয়েছি। তার বাইরে কিছু জানতে চাওয়া নির্বুদ্ধিতামাত্র। এখন আমি বুঝতে পেরেছি এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও আশঙ্কার সঙ্গে তাঁর সমস্ত বিধান মেনে চলাই সবচেয়ে ভাল। তার উপরেই জগৎ ও জীবনের সব কিছু নির্ভর করে।