অবশেষে রাজা তাদের দাবি মেনে নিয়ে তাদের দেশ ছেড়ে যাবার অনুমতি দেয়। কিন্তু তার কঠিন অন্তর বিগলিত হলেও তা আবার বরফের মতো কঠিন হয়ে ওঠে। তাই তার আদেশে তার সৈন্যরা প্রত্যাবর্তনরত সেই বিদেশীদের অনুসরণ করতে থাকে তাদের ধ্বংস করার জন্য।
সামনে বিশাল সমুদ্র, পিছনে শত্রুসৈন্য। মোজেস তখন সমুদ্রের কূলে এসে তার হাতের অলৌকিক দণ্ডটি তিনবার ঠুকতেই তাদের জন্য সমুদ্রের উপর পথ তৈরি হয়ে গেল। সে পথের দুধারে দুটি স্ফটিকস্বচ্ছ পাথরের প্রাচীর উঠে যায়। মোজেসের জাতির লোকেরা নিরাপদে সমুদ্র পার হয়ে ওপারের কূলে গিয়ে ওঠে।
এদিকে রাজার সৈন্যরা তাদের সমুদ্রের উপর হেঁটে যেতে দেখে সমুদ্রের জলে নামতেই তারা ডুবে যায়। ওপারে গিয়ে মোজেস তার দণ্ডটি আবার ফুঁকতেই সে পথ অদৃশ্য হয়ে যায় এবং ফ্যারাও-এর সৈন্যরা সব ডুবে যায়। যুদ্ধোন্মাদ সৈন্যদের যুদ্ধের সাধ মিটে যায়। তাছাড়া যাতে রাজসৈন্যরা পলায়মান মোজেসদের দেখতে না পায় তার জন্য ঈশ্বরপ্রেরিত এক দেবদূত দিনের বেলায় মেঘ এবং রাত্রিবেলায় ঘন অন্ধকার নিয়ে তাদের ঘিরে রেখে অপরিদৃশ্য করে তোলেন তাদের সৈন্যদের চোখ থেকে।
সমুদ্রের উপকূল থেকে মোজেসরা এবার দুর্গম মরুপথের উপর দিয়ে এগিয়ে চলতে থাকে। ক্রমে তারা ক্যান্নানে গিয়ে উপনীত হয়। কিন্তু ক্যান্নানবাসীরা মোজেসদের দেখে ভীত হয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মোজেসদের লোকেরা যুদ্ধবিদ্যায় অনভিজ্ঞ থাকায় তারা যুদ্ধ না করে আবার দাসত্বের ঝুঁকি নিয়ে মিশরেই ফিরে আসে।
সেখানে এসে তারা ঘুরতে ঘুরতে এক নির্জন বিশাল মরুপ্রান্তরের উপর এক রাজ্য স্থাপন করে। বারোটি উপজাতি থেকে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করে এক সিনেট বা পরিষদের মাধ্যমে শাসনকার্য চালাতে থাকে তারা। ঈশ্বর সিনাই পর্বতের শিখরদেশে নেমে এসে বজ্রবিদ্যুৎ ও জয়ঢাকের শব্দের মাধ্যমে আইনের বিধানগুলিকে তাদের জানিয়ে দেন।
অসামরিক ন্যায়বিচার ও শাসনপদ্ধতি, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, বলিদানের রীতি এবং মানবজাতির মুক্তির জন্য সাপের মাথায় আঘাত করতে তিনি তাদের শিখিয়ে দেন।
কিন্তু ঈশ্বরের কণ্ঠস্বর মরণশীল মানুষের কাছে ভয়ঙ্কর ও দুঃসহ। তাই তারা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানালে তিনি তার যা কিছু বলার তা যেন এবার থেকে তাদের নেতা মোজেসের মাধ্যমে তাদের জানিয়ে দেন। ঈশ্বর তাদের এ প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। তিনি তাদের জানিয়ে দেন, প্রাক্তন গুরু বা মাধ্যম ছাড়া ঈশ্বরের কাছে কেউ যেতে পারে না, তার কণ্ঠ শুনতে পায় না।
এইভাবে ঈশ্বরের নির্দেশে মোজেসের মাধ্যমে আইন ও আনুষ্ঠানিক রীতিনীতির প্রতিষ্ঠা হয়। তাঁর ইচ্ছা ও বিধানের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ আনুগত্য দেখে ঈশ্বর সন্তুষ্ট হন তাদের প্রতি। তিনি তাদের এক নূতন দেশে নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দেন।
তাঁর নির্দেশমতো দেবদারু কাঠের তৈরি স্বর্ণখচিত এক গাড়ি নির্মিত হয়। সেই পবিত্র গাড়ির মধ্যে দুটি দেবদূত এসে অধিষ্ঠিত হয়। তারা তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। এইভাবে তারা ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত দেশে এসে উপস্থিত হয়।
এরপর বলা হবে বহু যুদ্ধ, বহু বাজার ধ্বংস আর রাজ্যজয়ের কথা। বলা হবে কিভাবে একদিন মানুষের আদেশে সূর্য মধ্য আকাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সারাদিন, কিভাবে রাত্রির গতি স্তব্ধ হয়ে যায়। মানুষ আদেশ করে, হে সূর্য, হে চন্দ্র, যতদিন না ইসরায়েল জয় করতে পারি ততদিন রুদ্ধ হয়ে থাকবে তোমাদের গতি। এই ঈশ্বরপ্রেরিত মানুষ আইজ্যাকপুত্র তৃতীয় আব্রাহাম নামে অভিহিত হবে এবং তার থেকে নূতন বংশের উদ্ভব হবে, যে বংশ অবশেষে ক্যান্নান জয় করবে।
এইখানে আদম বলে উঠল, হে ঈশ্বরপ্রেরিত দেবদূত, আমার অন্ধকারের আলো, তুমি আব্রাহাম ও তার বংশ প্রভৃতি অনেক সুন্দর সুন্দর কথা ও কাহিনী বলেছ। এই সব কথা শুনে চোখ আমার খুলে গেছে। আগে আমার ও মানবজাতির ভবিষ্যৎ ভাবনায় আমার যে অন্তর বিব্রত ও জর্জরিত হয়ে উঠেছিল, এখন সে অন্তর সমস্ত দুশ্চিন্তা হতে মুক্ত ও স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। এখন আমি সেই দিন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যেদিন পৃথিবীর সব জাতি ঈশ্বরের আশীর্বাদে ধন্য হয়ে উঠবে। আমি একদিন নিষিদ্ধ জ্ঞান লাভ করতে গিয়ে ঈশ্বরের যে অনুগ্রহ হারাই সে অনুগ্রহ তারা লাভ করবে ভবিষ্যতে।
কিন্তু একটা জিনিস আমি বুঝতে পারছি না। বুঝতে পারছি না যে মানবজাতির মধ্যে ঈশ্বর বাস করতে চান পৃথিবীতে, সেই মানবজাতির মধ্যে এত সব আইনকানুন কেন? এত সব পাপের সঙ্গে সেই সব আইনকানুনকে লড়াই করতে হয় কেন? কি করে ঈশ্বর মানুষের সঙ্গে বাস করতে পারেন?
মাইকেল তখন তাকে বলল, ভেবো না সেই সব মানুষের মধ্যে কোন পাপ থাকবে না। তাই তাদের সহজাত পাপপ্রবৃত্তিকে দমন করার জন্য আইনের বিধান দেওয়া হয়। আইনের বিধান পাপের সঙ্গে লড়াই করে পাপকে সংযত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু যখন তারা দেখবে আইন পাপকে প্রকাশ করতে পারে, কিন্তু সে পাপকে বিদূরিত করতে পারে না, যখন বুঝবে পাপপ্রবৃত্তির প্রতীকস্বরূপ বলদ, ছাগ প্রভৃতি পশুগুলি পাপ-দূরীকরণের এক দুর্বল উপায়মাত্র, তখন তারা ভাববে মানুষের পাপমুক্তির জন্য আরও মূল্যবান রক্তদান দরকার যাতে করে অন্যায়ের উপর ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা হতে পারে, যাতে তার বিবেকবুদ্ধি জাগ্রত হতে পারে এবং ঈশ্বরের প্রতি ন্যায়পরায়ণ ও বিশ্বস্ত হতে পারে যা কোন আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মের দ্বারা সম্ভব নয়। তারা বুঝতে পারবে জীবনে ন্যায়নীতি মেনে না চললে ভালভাবে তারা বাঁচতে পারবে না।