মাইকেল তখন বলল, তুমি সঙ্গতভাবেই ঐ মানবসন্তানের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেছ। কারণ সে মানুষের যুক্তিসঙ্গত ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে শান্তিপ্রিয় মানবজাতির উপর অশান্তি নিয়ে এসেছে। প্রকৃত স্বাধীনতা সব সময় যুক্তির সঙ্গে সহাবস্থান করে।
কিন্তু সেই যুক্তিকে জোর করে আচ্ছন্ন করে দিলে বা তাকে না মানলে অসঙ্গত উদ্ধত কামনার বেগ শাসনযন্ত্রকে যুক্তিবিবর্জিত করে স্বাধীন মানুষকে দাসে পরিণত করে তোলে। যে শক্তির সে যোগ্য নয় সেই শক্তি দিয়ে তার স্বাধীন চিন্তা ও যুক্তিবোধকে দমিয়ে রাখে। ফলে ঈশ্বরের বিচারে সেই উদ্ধত স্বৈরাচারী মদন রাজা তার থেকে আরও শক্তিশালী রাজাদের কাছে পরাজিত হয়ে তাদের অধীন হয়ে পড়ে। বাইরের স্বাধীনতা হারিয়ে তারা তাদের দাস হয়ে পড়ে। অত্যাচারী অত্যাচারের শিকারে পরিণত। এইভাবে অনেক জাতি অন্য জাতির স্বাধীনতা গ্রাস করে নিজেরাই আবার অপর জারি পরাধীন হয়ে ওঠে। ঈশ্বর এইসব দেখে শুনে এইসব পাপাত্মাদের ভাগ করে তাদের কুপথে চলতে ছেড়ে দেন। নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি করে যায় নিজেরা।
এরপর যারা বেঁচে থাকবে তাদের মধ্যে একজন ধার্মিক লোক থেকে এক নূতন জাতির উদ্ভব হবে ইউফ্রেটিস নদীর ধারে। প্রথমে সেই জাতি পৌত্তলিক ছিল। নির্বোধের মতো পুতুল পূজা করত। মহাপ্লাবন হতে উদ্ধারপ্রাপ্ত ও ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য প্রধান পিতা নোয়া তখন জীবিত থাকলেও সেই জীবম্ভ ঈশ্বরস্বরূপ তাঁকে ছেড়ে তারা যত কাঠ-পাথরকে দেবতা বলে পূজা করত।
অবশেষে ঈশ্বর একদিন স্বপ্নে আদেশ দেন, পৈতৃক বাড়ি ও সেই সকল দেবতাদের মৃতিগুলিকে ছেড়ে অন্য দেশে যেতে হবে। তিনি আরও বলেন, তার থেকে এক শক্তিশালী জাতির উদ্ভব হবে এবং সেই জাতি ঈশ্বরের আশীর্বাদলাভে ধন্য হবে। কোথায় তিনি থাকেন তা পরে বলে দেবেন।
ঈশ্বরের সেই প্রত্যাদেশ যথাযথভাবে পালন করলেন তিনি। তিনি জানেন না কোন দেশে কোথায় যাবেন তিনি। তিনি তাঁর গভীর অবিচল বিশ্বাসের জন্য যথাসময়ে ঈশ্বরই তাকে তা বলে দেবেন। তিনি যেখানে তাকে নিয়ে যাবেন।
মাইকেল আরও বলল, তুমি জান না, কিন্তু আমি জানি, তিনি কোন বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে দক্ষিণ বেবিলনের অন্তর্গত তাঁর জন্মভূমি, গৃহদেবতা ও বন্ধুবান্ধবদের পরিত্যাগ করে অজানার পথে যাত্রা করেন। তাঁর সঙ্গে বহু পশুর পাল আর বহুসংখ্যক ভৃত্য ও অনুচরবর্গও যায়। তিনি একেবারে নিঃস্ব ছিলেন না তখন। তাঁর কাছে যে ধনসম্পদ ছিল তার ভার ঈশ্বরের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি।
এইভাবে তিনি আঁর দলবল নিয়ে ক্যান্নানে এসে উপস্থিত হন। জেরুজালেমের উত্তরে মধ্য প্যালেস্টাইনের সমভূমিতে অবস্থিত সেকেম বা মোবে নগরে তাঁর তাঁবুর ছাউনি আমি দেখতে পাচ্ছি।
ঈশ্বরের নির্দেশে সেখানে গিয়ে তিনি সেই সমগ্র ভূখণ্ড ভঁর ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য দান হিসাবে লাভ করেন। উত্তরে সিরিয়া থেকে দক্ষিণের মরুভূমি পর্যন্ত, পূর্বে হার্মন ও কার্মেন পাহাড় থেকে পশ্চিম সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ড। জর্ডন নদী তার পূর্বদিকের শেষ সীমান্ত। সেই প্রবীণ পিতার বংশ থেকে সমগ্র পৃথিবী ধন্য হবে।
তাঁর বংশধরের অর্থ হলো মানবজাতির মহান পরিত্রাতা যিনি সাপের মাথায় আঘাত হানবেন। তোমার সামনে তিনি পরিষ্কাররূপে আবির্ভূত হবেন।
ঈশ্বরের অনুগ্রহীত এই প্রবীণ পিতা পরে পরম ঈশ্বরবিশ্বাসী আব্রাহাম নামে অভিহিত হলেন। তাঁর একটিমাত্র পুত্র আর একটিমাত্র পৌত্র হবে। ধর্মবিশ্বাস, জ্ঞান ও খ্যাতিতে তারা হবে তাঁরই মতো।
পরে তাঁর পৌত্র তাঁর বারোজন পুত্র নিয়ে ক্যান্নান থেকে নীলনদের দ্বারা বিভক্ত মিশর দেশে চলে যান। তার কনিষ্ঠ পুত্র মিশরেই থাকত এবং কান্নানে তখন দুর্ভিক্ষ চলতে থাকার জন্য সেই কনিষ্ঠ পুত্র তাকে মিশরে থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। এই পুত্রটি এমনই কতকগুলি গৌরবজনক কাজ করে মিশর দেশে যার জন্য সে দেশের রাজা ফ্যারাওর পরেই তার স্থান ছিল।
পরে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয় এবং তার উপজাতি বাড়তে বাড়তে এক জাতিতে পরিণত হয়।
ঐ দেখ মিশরের নীলনদ মোহ্নর কাছে সাতটি মুখ নিয়ে সমুদ্রে পতিত হয়েছে।
এদিকে ক্রমে সেই বিদেশাগত জাতির শক্তিবৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে ফ্যারাও তাদের ক্রীতদাসে পরিণত করে অত্যাচার চালাতে থাকে তাদের উপর। তাদের পুত্রসন্তান হলেই শিশু অবস্থাতেই তাদের মেরে ফেলত।
পরে সেই জাতির মধ্যে দুজন ঈশ্বরপ্রেরিত পুরুষ আসেন। তাঁরা হলেন মোজেস আর এ্যারন। এঁরা রাজার কাছে অঁদের জাতির দাসত্ব থেকে মুক্তির দাবি জানান, মিশর থেকে তাঁরা স্বদেশে ফিরে যেতে চান। কিন্তু তার আগে যে অত্যাচারী নিষ্ঠুর রাজা ঈশ্বরে বিশ্বাস করত না বা তাঁর বিধান মানত না তাকে ককগুলি কুলক্ষণ বা বিভিন্ন দুর্ঘটনার দ্বারা এ বিষয়ে অনুমতি দান করতে বাধ্য করতে হবে।
ঈশ্বরের বিধানে দেশের সব নদীর জল রক্তে পরিণত হয়ে উঠবে। ব্যাঙ, উকুন ও মাছি ঝাঁকে ঝাঁকে রাজপ্রাসাদ পরিপূর্ণ করে তুলবে। রাজার পশুদের মৃত্যু ঘটবে অকারণে। রাজার সারা দেহ ক্ষত ও ফোঁড়ায় পূর্ণ হয়ে উঠবে। আরঝড়ের সঙ্গে বজ্রাঘাতে বজ্রাগ্নিতে দেশের বহু লোকের জীবননাশ হবে। বহু গাছপালা পুড়ে যাবে। ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপাল নেমে এসে মাঠের সব সবুজ ফসল খেয়ে ফেলবে। তিন দিন ধরে এক নিবিড় অন্ধকার আচ্ছন্ন করে থাকবে সমস্ত দেশকে। একদিন গভীর রাত্রিতে দেশের সব নবজাত শিশুর মৃত্যু হবে।