প্রধান দেবদূত মাইকেল বলল, তুমি ঠিকই লক্ষ্য করেছ। এখন তার ক্রোধ স্বেচ্ছায় প্রশমিত করেছেন। মানবজাতির ধ্বংসে তিনি এখন অনুতপ্ত। একদিন তিনি সমস্ত পৃথিবীকে হিংসায় পরিপূর্ণ ও সমস্ত মানুষকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেখে রাগে দুঃখে অভিভূত হয়ে পড়েন। পরে যখন তিনি দেখলেন অন্তত একজন ন্যায়বান মানুষ আছে পৃথিবীতে তখন তিনি সমগ্র মানবজাতিকে একেবারে ধ্বংস না করে ঐ একজনকে সপরিবারে বাঁচিয়ে রাখলেন। তিনি ধনুকবিধৃত মেঘখণ্ডের মাধ্যমে ঘোষণা করলেন আর কখনো কোন মহাপ্লাবনের দ্বারা ধ্বংস করবেন না পৃথিবীকে। আর কখনো সমুদ্র তার বেলাভূমি অতিক্রম করবে না, অতিবৃষ্টি ভাসিয়ে দেবে না পৃথিবীকে। ধনুকের তিনটি রঙের মাধ্যমে তিনি ঘোষণা করে দিলেন, পৃথিবীতে চিরকাল দিনরাত্রি, বীজবপন ও শস্যকর্তন শীত, গ্রীষ্ম যথারীতি চলতে থাকবে। তারপর একদিন আগুনে পরিশুদ্ধ স্বর্গ-মর্ত নূতনভাবে গড়ে উঠবে। ন্যায়ের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে পৃথিবীতে।
১১শ সর্গ
একাদশ সর্গ
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মাইকেল বলল, তুমি তোমার চোখের সামনে একটি পুরনো জগৎকে শেষ হয়ে যেতে ও একটি নূতন জগৎকে শুরু হতে দেখবে। যেন এক নূতন প্রজন্ম থেকে শুরু হবে মানবজাতির অগ্রগতি। তবু আরো অনেক কিছু দেখতে হবে তোমায়। কিন্তু তোমার দর্শনেন্দ্রিয় স্তিমিত হয়ে এসেছে। তোমার ক্লান্ত ইন্দ্রিয়শক্তিকে সতেজ করার জন্য ঐশ্বরিক সাহায্য দরকার। এরপর কি হবে তা আমি বলব। এখন তা মন দিয়ে শুনবে।
অবশিষ্ট মানবজাতি নবজীবন লাভ করল মং প্লাবনের পর। কিন্তু মানুষের সংখ্যা তখন নিতান্তই কম। ঐশ্বরিক বিচারের স্মৃতি তখন ভালভাবেই জেগে ছিল তাদের মনে। তারা দৈব ভয়ে ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে ঠিক সৎ পথেই চলবে। এইভাবে তারা জীবন যাপন করে বংশবৃদ্ধি করে যাবে। তারা মাঠে শ্রমসহকারে চাষের কাজ করে প্রচুর ফসল ফলাবে। অনেক শস্য, মদ ও তেল উৎপন্ন করবে। মাঝে মাঝে ধর্মীয় উৎসবের অনুষ্ঠান করে তাদের পশুর পাল থেকে বলদ, মেষশাবক অথবা ছাগলছানা দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দিয়ে মদের অঞ্জলি দেবে। তারা পিতৃতান্ত্রিক সমাজে পরিবার ও জাতিসহ দীর্ঘকাল সুখে শান্তিতে নিষ্কলুষ ও নির্দোষ জীবন যাপন করবে। পরে তাদের মধ্যে একজন অহঙ্কারী উচ্চাভিলাষী মানুষের আবির্ভাব হবে। সে এই সৌভ্রাতৃত্বমূলক সমাজে সাম্যবস্থায় তৃপ্ত হবে না। সে প্রাকৃতিক নিয়ম লঙঘন করে পৃথিবীর বুক থেকে সব ঐক্য বিনষ্ট করে তার সমাজের ভাইদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে রাজ্য স্থাপন করবে আপন শক্তিবলে।
ঈশ্বরের বিধানকে অগ্রাহ্য করে সে এক শক্তিশালী শিকারীরূপে যুদ্ধবিগ্রহের কুটিল ফাঁদ পেতে মানুষ ও পশুশিকারে মত্ত হয়ে উঠবে। যারা তার দ্বারা স্থাপিত সাম্রাজ্যের কাছে বশ্যতা বা অধীনতা স্বীকার করবে না, তাদের উপর সে নিষ্ঠুরভাবে পীড়ন ও অত্যাচার চালাবে। সর্বশক্তিমান জগদীশ্বরের কাছে সে দ্বিতীয় সার্বভৌম শক্তিরূপে নিজের প্রতিষ্ঠা দাবি করবে।
এইভাবে সে ঈশ্বরদ্রোহিতার দ্বারা নাম-যশ অর্জন করবে। অথচ যারা তার এই প্রভুত্বকে স্বীকার করতে চাইবে না তাদের সে বিদ্রোহী হিসাবে চিহ্নিত করবে এবং তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ আনবে।
যারা তার উচ্চাভিলাষ ও অত্যাচারের শরীক হবে তাদের নিয়ে এক সেনাদল গঠন করে ইডেন উদ্যান থেকে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে এক সমতল প্রান্তর পাবে, যে প্রান্তরের শেষে একটি বিশাল খাদ আছে। সেই খাদই হলো নরকের মুখ।
সেই প্রান্তরের উপর ইট ও পাথর দিয়ে বহু সৌধসমম্বিত এক নগর প্রতিষ্ঠা করবে। যার চূড়া উচ্চতায় স্বর্গলোকের কাছাকাছি উঠে যাবে। তারা প্রভুত যশ অর্জন করবে। কিন্তু রাজ্যজয়ের মোহে সে যশ শুভ কি অশুভ সেকথা বিচার করতে ভুলে যাবে তারা।
কিন্তু ঈশ্বর মাঝে মাঝে অদৃশ্য অবস্থায় নেমে আসেন মানুষের জগতে। তাদের আবাসভূমিতে ঘুরে বেড়িয়ে তাদের কর্মকর্ম দেখেন খুঁটিয়ে। সেইসব অহঙ্কারী উচ্চাভিলাষী লোকদের দ্বারা নবনির্মিত নগরটি দেখে তিনি সেই নগরে একদিন নেমে আসবেন। দেখবেন তাদের সেই নগরের স্পর্ধিত চূড়া স্বর্গলোককে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। তখন তিনি সেই নগর নির্মাতাদের মুখে বিভিন্ন জাতীয় ভাষা দান করবেন যার ফলে তারা কেউ কারো কথা বুঝতে পারবে না। এর ফলে তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ করে নিজেদের গড়া নগর নিজেরাই ধ্বংস করে ফেলবে।
তাদের গোলমাল, চিৎকার ও তর্জনগর্জন স্বর্গলোকের সবাই শুনতে পাবে এবং তারা সবাই হাসাহাসি করবে।
আদম এতে অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, হে দুষ্ট মানবসন্তান, ঈশ্বর তো আমাদের জগতের পশুপাখি, জল, স্থল, আকাশ সব কিছুর উপর প্রভুত্ব দান করেছেন, একমাত্র মানুষ ছাড়া। মানুষ মানুষের উপর প্রভুত্ব করবে না। একমাত্র ঈশ্বরই সকল মানুষের প্রভু। কিন্তু তুমি ঈশ্বরের কাছে থেকে সে প্রভুত্ব জোর করে ছিনিয়ে নিয়েছ। সমগ্র মানবজাতির উপর প্রভুত্ব বিস্তার করে রাজ্যস্থাপন করেছ। তুমি শুধু মানুষের সব অধিকারকে গ্রাস করনি, স্বর্গ অবরোধ করে সেখানেও তোমার অন্যায় অবৈধ প্রভুত্ব বিস্তার করতে চেয়েছ। কিভাবে তুমি ও তোমার হঠকারী সেনাদলকে বাঁচিয়ে রাখবে ঈশ্বর ও প্রকৃতির রোষ থেকে? হে হতভাগ্য মানবসন্তান, স্বর্গ থেকে প্রতিকূল বাতাস ঈশ্বরের রোষ হিসাবে নেমে এসে তোমাদের নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে দেবে। তোমাদের প্রাণবায়ু স্তব্ধ করে দেবে।