তখন মাইকেল বলল, তুমি বিজয়গর্বে গর্বিত যে সব মানুষকে ঐশ্বর্যে ও বিলাসব্যসনে মত্ত থাকে দেখেছ, যাদের কোন প্রকৃত গুণ ছিল না তারাই এই ঈশ্বরসৃষ্ট মহাপ্লাবনের প্রথম বলি হবে।
তুমি দেখেছ যারা একদিন অনেক রক্তপাত ঘটিয়ে অনেক ধ্বংস করে অনেক জাতিকে জয় করে জগতে প্রভুত্ব ও যশ অর্জন করে, অনেক উপাধিতে ভূষিত হয় এবং অনেক ঐশ্বর্যলাভ করে, তারাই পরে শান্তির সময়ে তাদের জীবনের গতিপথের পরিবর্তন করে আবার স্বাচ্ছন্দ্য, আনন্দ, অহঙ্কার, বিলাস আর আলস্যের স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। বিজিত জাতিরা তাদের স্বাধীনতা হারিয়ে দাসত্বের জীবন যাপন করতে থাকে। স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে সব সগুণও তারা হারিয়ে ফেলে। যে ধর্ম, যে ঈশ্বর তাদের আক্রমণকারীদের হাত হতে রক্ষা করতে পারেনি, যে ধর্ম ও ঈশ্বরের প্রতি সব ভয়, সব আস্থা হারিয়ে ফেলে তারা, যখন তাদের জীবনের সমস্ত উত্তপ্ত উদ্যম, সমস্ত কর্মতৎপরতার উত্তাপ শীতল হয়ে যায়, তখন তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হয় কিভাবে তারা নিরাপদে বেঁচে থাকবে। কিভাবে তারা তাদের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখবে। তাদের নূতন প্রভুরা কতখানি বাঁচার আনন্দ তাদের উপভোগ করতে দেবে সেটাই তাদের একমাত্র চিন্তা হয়ে ওঠে। জগতে ও জীবনে আরো কত ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে হবে এই কথাই ভাবতে থাকে তারা। ফলে মানবশিক্ষার দিক থেকে দ্রুত অধঃপতন ঘটতে থাকে তাদের। ন্যায়পরায়ণতা, সহিষ্ণুতা, সত্য, ধর্মবিশ্বাস প্রভৃতির কথা সব তারা ভুলে যায়। ‘ কোন একটিমাত্র মানুষ, অন্ধকার যুগে পাপে পরিপূর্ণ পৃথিবীতে আলোর সন্তানরূপে সমস্ত প্রলোভন, প্রধানত কুসংস্কার, সমস্ত নিন্দা, ঘৃণা ও হিংসাকে অগ্রাহ্য করে ‘নির্ভীকভাবে পৃথিবীর মানুষকে অধর্ম ও অন্যায়ের পথে যাওয়ার জন্য তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করবেন এবং তাদের সেই ন্যায় ও শান্তির পথ দেখাবেন যে পথে গেলে ঈশ্বরের রোষ কখনো নেমে আসবে না তাদের উপর।
কিন্তু মানুষ তার কথা শুনবে না, তার পথ অবলম্বন করবে না। তিনি শুধু তাদের কাছ থেকে বিদ্রূপ ও উপহাস লাভ করে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাবেন। তবে ঈশ্বর দেখতে পাবেন পৃথিবীতে একটিমাত্র ন্যায়পরায়ণ মানুষ এখনো জীবিত আছে। তখন ঈশ্বরের আদেশে সেই ন্যায়বান ও সৎ ব্যক্তি একটি আশ্চর্য অর্ণবপোত নির্মাণ করবে যার দ্বারা সে নিজেকে ও তার পরিবারবর্গকে সর্বধ্বংসী, সর্বগ্রাসী মহাপ্লাবনের হাত হতে উদ্ধার করতে পারবে। সে পোত তুমি দেখেছ।
তার নির্বাচিত মানুষ ও পশুপাখিসহ তিনি সেই জাহাজে উঠে বসলেই আকাশ থেকে অবিরল অবিরাম ধারায় বর্ষণ শুরু হলো। সেই বর্ষণে সমস্ত সমুদ্র ও মহাসমুদ্র তাদের সব বেলাভূমি অতিক্রম করে সমগ্র পৃথিবীকে প্লাবিত করল। এমন কি পাহাড়গুলি পর্যন্ত সব ডুবে গেল। সেই উত্তাল জলরাশির আঘাতে মর্ত্যলোকের এই স্বর্গীয় পাহাড়টি পর্যন্ত স্থানচ্যুত হয়ে যায় এবং সেখানে এক দ্বীপ জেগে ওঠে। এই ঘটনার দ্বারা এই শিক্ষা পেলে যে মর্ত্যলোকের কোন স্থানকে ঈশ্বর কোন গুরুত্ব দিতে চান না যদি না সেখানে মানুষ বাস না করে বা যাতায়াত না করে। এবার এরপর কি হলো তা দেখ।
আদম তখন সেদিকে তাকিয়ে দেখল, সব মেঘ ও বন্যার বেগ কমে গেছে। শুষ্ক দক্ষিণা বাতাসের তাড়নায় সঙ্কুচিত হয়ে উঠল বন্যায় স্ফীত মুখ। মেঘমুক্ত আকাশের সূর্য উত্তপ্ত কিরণ বিকীরণ করায় বন্যার জলে ভাটা পড়ল। সব সমুদ্র এবার স্বাভাবিক আকার ধারণ করল। বৃষ্টি একেবারে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আর স্ফীত হলো না সমুদ্রের বুক। নোয়ার জাহাজটি বন্যার জলে আর ভাসতে থাকল না, একটি পাহাড়ের উপর স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইল।
দেখতে দেখতে পাহাড়ের প্রস্তরমণ্ডিত মাথাগুলি জেগে উঠল। নোয়ার জাহাজ থেকে প্রথমে এক দাঁড়কাক উড়ে গেল। তারপর একটি কপোত উড়ে গেল কোন গাছ বা মাটি পাওয়া যায় কিনা তা দেখার জন্য। কিছুক্ষণ পর কপোতটি তার ঠোঁটে করে একটি অলিভ পাতা নিয়ে এল। এই অলিভ পাতা শান্তির চিহ্ন।
ক্রমে শুকনো মাটি জেগে উঠল। প্রবীণ পিতা নোয়া তখন তাঁর দলবল নিয়ে জাহাজ থেকে নেমে পড়লেন। তিনি দুহাত তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা জানালেন ঈশ্বরকে। তখন আকাশে এক শিশিরসিক্ত মেঘ দেখা গেল। সেই মেঘে তিনরঙা এক ধনু দেখা গেল শান্তির প্রতীক হিসাবে।
এই দৃশ্য দেখে বিষণ্ণ আদম সব বিষাদ ঝেড়ে ফেলে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। সে বলল, হে স্বর্গীয় শিক্ষক, তুমি ভবিষ্যতের ঘটনাবলীকে বর্তমানে পরিণত করতে পার। আমি সেই শেষ দৃশ্যটি দেখে এই বুঝে আশ্বস্ত হলাম যে ভবিষ্যতে সব কিছু সত্ত্বেও মানুষ পর্যন্ত সমস্ত প্রাণীকুলের সঙ্গে বাঁচতে পারবে। অসংখ্য দুষ্ট প্রকৃতির মানুষে ভরা একটি জগৎকে ধ্বংস হয়ে যেতে দেখে যত না দুঃখ পেয়েছিলাম তার থেকে একটি সর্বগুণমণ্ডিত ও ন্যায়পরায়ণ মানুষকে বেঁচে থাকতে দেখে অনেক বেশি আনন্দ পেলাম। ঈশ্বর মানবজাতির প্রতি সব রাগ দুঃখ ভুলে গিয়ে সেই ন্যায়বান ও সাধুপ্রকৃতির মানুষ থেকে এক নূতন জগৎ গড়ে তুলতে চান। এখন বল, ঈশ্বরের শান্ত কুটির মতো আকাশে আবির্ভূত তিনরঙা ধনুকশোভিত ঐ মেঘখণ্ডটির অর্থ কি? তিনি কি আবার পৃথিবীকে জলের তলায় তলিয়ে দিয়ে ধ্বংস করতে চান?