এই হচ্ছে আমাদের বর্তমান অবস্থা। এই অবস্থা যদি আমরা এখন সহ্য করে যেতে পারি তাহলে আমাদের সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের ক্রোধ হয়ত প্রশমিত হতে পারে, এমন কি সে ক্রোধ হয়ত দূরীভূত হয়ে যেতেও পারে। ক্রমে সে আমাদের কথা ভুলে যাবে একেবারে। আমরা যে শাস্তি এখন ভোগ করছি সেই শাস্তিতেই সন্তুষ্ট থাকবে সে। যদি তার ক্ৰোধতপ্ত নিঃশ্বাস ঐ জ্বলন্ত অগ্নির শিখাগুলিকে নতুন করে উদ্দীপিত না করে তাহলে ক্রমে নিস্তেজ ও স্তিমিত হয়ে আসবে সে অগ্নি, আমাদের সহিষ্ণুতার দ্বারা আবার সে অগ্নির ধূমরাশি ও ভয়ঙ্কর তাপকে জয় করব আমরা।
কালক্রমে আমরা হয়ত এই স্থানের ভূপ্রকৃতি ও আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারব নিজেদের। ক্রমে হয়ত যন্ত্রণাহীন ও সহনীয় হয়ে উঠবে এই দুঃসহ উত্তাপ। এই অন্ধকার হয়ে উঠবে আলো।
কিন্তু একবার ভেবে দেখ যদি আমরা আক্রমণ করে ব্যর্থ হয়ে এই স্থানটুকুও হারাই, যদি চিরকাল আমাদের পালিয়ে বেড়াতে হয়, তাহলে কোন প্রত্যাশায় অনন্তকাল ধরে প্রতীক্ষা করে যাব আমরা? তার থেকে বর্তমানের এই অবস্থা যত খারাপই হোক, তার তুলনায় অনেক সুখের, যদি আমরা নতুন করে কোন দুঃখকে ডেকে না আনি।
এইভাবে এক অপমানজনক শাস্তি, আলস্য আর অকর্মণ্যতাকে যুক্তির আবরণে আবৃত করে ব্যক্ত করে গেল বিলায়েল। তারপর ম্যামন বলতে উঠল।
সে বলল, আমরা কিজন্য যুদ্ধ চাইছি? হয় স্বর্গের রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করতে অথবা আমাদের হারানো অধিকারকে পুনরায় লাভ করতে।
কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে আমরা স্বর্গের রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করার আশা করতে পারি না। সুতরাং এ আশা আমাদের বৃথা। স্বর্গের অধিপতিকে সম্পূর্ণরূপে পরাভূত করতে না পারলে স্বর্গের মধ্যে কি করে স্থান পাব আমরা?
মনে করো, আমরা নরম হয়ে আত্মসমর্পণ করে আমাদের প্রতিপক্ষের করুণা ভিক্ষা করলাম। ধরে নাও, আমরা তার প্রভুত্ব মেনে নিয়ে আমাদের বশ্যতা স্বীকার করলাম নতুন করে। কিন্তু তার ফলে তার সামনে বিনয়াবনত হয়ে থাকতে হবে আমাদের। আমাদের উপর যে সব কঠোর বিধিনিষেধ আরোপিত হবে তা নির্বিবাদে মেনে চলবে হবে আমাদের। তার অবিসম্বাদিত আধিপত্য মেনে নিয়ে আবেগপূর্ণ ভাষায় স্তোত্ৰগান করে তুষ্ট করতে হবে তাকে। তিনি সর্বশক্তিমান সার্বভৌম প্রভু হিসাবে বসে থাকবেন তার সিংহাসনে আর তাঁকে ভগবান হিসাবে মেনে নিয়ে তার ঐশ্বরিক বেদীতে পুস্পাঞ্জলি দিতে হবে আমাদের অবনত মস্তকে। তাঁর সেবকরূপে।
স্বর্গলোকে এই হবে আমাদের একমাত্র আনন। অনন্তকাল ধরে এই হীন কর্ম করে যেতে হবে আমাদের। যাকে আমরা অন্তরের সঙ্গে ঘৃণা করি, আমাদের কাছে যে একেবারে অবাঞ্ছিত তাকেই পূজো করে যেতে হবে।
যে শক্তি, যে বল আমাদের পক্ষে লাভ করা সম্ভব নয় সে শক্তির মোহে আমরা যেন সবকিছু ভুলে মোহগ্রস্ত না হই, যে যুক্তি গ্রহণীয় নয় তা যেন আমরা গ্রহণ না করি। স্বর্গে গিয়ে পরের ঐশ্বর্যে ঐশ্বর্যবান হবার কামনা ত্যাগ করে আমরা নিজেরা নিজেদের মানের কথা চিন্তা করি, নিজেদের শক্তিতে বেঁচে থাকার জন্য সচেষ্ট হই।
এক বিশাল নরকপ্রদেশে আর যাই হোক, আমাদের অবস্থা যত খারাপ হোক না কেন, আমরা অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে চলেছি। এই স্বাধীনতা দুঃখকষ্টপূর্ণ দাসত্ব থেকে অনেক ভাল। আমাদের মহত্ত্ব সবচেয়ে প্রকটিত হয় তখনই যখন আমরা আমাদের শ্রমে ও সহিষ্ণুতার দ্বারা ছোট জিনিস থেকে বড় কিছু করতে পারি, অব্যবহার্য বস্তুকে ব্যবহার্য করে তুলতে পারি, দুরবস্থা হতে সমৃদ্ধি লাভ করতে পারি এবং যন্ত্রণাদায়ক অবস্থাকে আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যে পরিণত করতে পারি। আমরা কি এই অন্ধকার নরকের গভীর গহুরকে ভয় করি?
কিন্তু তোমরা দেখেছ স্বর্গলোকের সর্বাধিপতি কতবার সঘন ধূমরাশির অন্ধকারের দ্বারা তার সিংহাসনকে পরিবৃত করে তার সকল গৌরব ও ঐশ্বর্যকে আচ্ছন্ন করে রাখে। সেই ধূমরাশি হতে গভীর গর্জনে ফেটে পড়ে কত বজ্র। সমগ্র স্বর্গলোক হয়ে ওঠে নরকের মত। সে যদি এইভাবে আমাদের নারকীয় অন্ধকারের নকল করে তার দ্বারা নিজেকে পরিবৃত করে রাখতে পারে তাহলে আমরা কি তার স্বর্গীয় আলোর নকল করে সেই আলোকে এই নরকে নিয়ে আসতে পারি না? দেবতাদের দ্বারা পরিত্যক্ত এই নরকপ্রদেশের গর্ভেও কি মণি, মুক্তো, সোনা প্রভৃতি উজ্জ্বল ধনরত্ন : নিহিত নেই? আমাদেরও কি এমন কোন কলাকৌশল নেই যার দ্বারা আমরা সেই সব বস্তু ও ধনৈশ্বর্যকে উদ্ধার করতে পারি? স্বর্গে এর থেকে বেশি কি ঐশ্বর্য আছে?
জ্বলন্ত অগ্নির নির্মম দহনজনিত যে জ্বালাময় পীড়ন আমরা এখন অহেরহ ভোগ করে চলেছি, কালক্রমে তা সহনীয় হয়ে আমাদের পরিবেশগত ভৌতিক উপাদানে পরিণত হয়ে উঠতে পারে। কালক্রমে তাদের প্রকৃতি আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ফলে আমাদের যন্ত্রণা ও সকল বেদনা বিদূরিত হতে পারে।
এখন আমাদের সামনে যে সমস্যা সমুপস্থিত এর জন্য চাই শান্তিপূর্ণ সমাধান। চাই শান্তি ও শৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠা। এখন আমাদের ভেবে দেখতে হবে কিভাবে আমরা আমাদের এই বর্তমানের বাস্তব অবস্থাকে মেনে নিয়ে এই অশুভ অসহনীয় অবস্থাকে উন্নতির সোপান হিসাবে ব্যবহার করতে পারি। তার জন্য প্রথমেই যুদ্ধের সকল চিন্তাকে অপসারিত করে ফেলতে হবে মন থেকে। এই হলো আমার পরামর্শ তোমাদের প্রতি।