যে লোকটিকে ঈশ্বর উদ্ধার করেন সে হচ্ছে তোমার বংশধরদের মধ্যে সপ্তম সন্তান। অন্যায়, অধর্ম ও পাপের জগতে সেই ছিল একমাত্র ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি। একমাত্র সেই বলেছিল ঈশ্বরের ন্যায়ের দণ্ড সকল অন্যায়ের উপর নেমে আসবে একদিন। ঈশ্বর সকলের বিচার করবেন।
এর দ্বারা তোমাকে দেখালাম ঈশ্বর ন্যায় ও সত্যপরায়ণ ব্যক্তিকে কিভাবে উদ্ধার করেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে এবং অন্যায়কারীদের একদিন ঐশ্বরিক শাস্তি ভোগ করতেই হবে। আবার দেখ।
আদম আবার তাকিয়ে দেখল সে দৃশ্য আর নেই। যুদ্ধের কণ্ঠ এখন তীব্র গর্জন থেকে বিরত হয়েছে। যুদ্ধের মারামারি কাটাকাটি এখন পরিণত হয়েছে আনন্দোচ্ছল ক্রীড়াচঞ্চলতায়। রণক্ষেত্র রূপান্তরিত হয়েছে ভোজসভা, বিলাসব্যসন আর ব্যভিচারে। পথচারীরা সুন্দরী নারীদের দেখে আকৃষ্ট হয়ে পতিতালয়ে যাচ্ছে। সেখানে গিয়ে মদ্যপান করতে করতে ঝগড়া-বিবাদে প্রবৃত্ত হচ্ছে।
অবশেষে বয়োপ্ৰবীণ এক শ্রদ্ধেয় জ্ঞানী ব্যক্তি এসে তাদের জীবনযাত্রা ভ্রান্ত ও অসৎ বলে ঘোষণা করলেন। তাদের সেই অবাঞ্ছিত কর্মের বিপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বারবার বিভিন্ন স্থানে আলোচনা করতে লাগলেন তাদের সঙ্গে। এমন কি কোন উৎসবে যোগ দিয়েও তিনি তাদের জ্ঞান দিতে লাগলেন। তাঁর নাম ছিল নোয়া।
কিন্তু তার সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হলো। তারা তাঁর কোন কথা না শুনে সেই অন্যায়, অবিচার, ব্যভিচারের পথেই চলতে লাগল। তখন সেই জ্ঞানী ব্যক্তি আর তাদের সঙ্গে কোন তর্কবিতর্কে প্রবৃত্ত হলেন না। তাদের আর জ্ঞান দানের কোন চেষ্টা করলেন না।
তিনি তখন দূরে একটি পাহাড়ের উপর গিয়ে তাঁবু ফেলে বাস করতে লাগলেন নির্জনে। একদিন বড় বড় কতকগুলি গাছ কেটে তার কাঠ দিয়ে এক বিশাল অর্ণবপোত নির্মাণ করলেন। দৈর্ঘ্যে, প্রস্থে, উচ্চতায় সব দিক দিয়েই সে পোত হলো বিরাট। তার একটি দিকে মাত্র একটি দরজা করা হলো। কিছু সংখ্যক মানুষ ও পশুর জন্য অনেক পরিমাণে খাদ্য ভরে নেওয়া হলো সেই জাহাজে যাতে বেশ কিছুদিন চলতে পারে। তারপর এক এক জাতীয় পশু, পাখি ও কীটপতঙ্গ হতে নারী-পুরুষ মিলিয়ে সাত জোড়া করে সেই জাহাজে তুলে নিলেন।
সবশেষে সেই ধার্মিক নোয়া তাঁর স্ত্রী, ভঁর তিনজন পুত্র আর তাদের স্ত্রীদের নিয়ে সেই জাহাজে উঠলেন। ঈশ্বর তখন আপন হাতে সে জাহাজের একটিমাত্র দরজা শক্ত করে এঁটে দিলেন।
সঙ্গে সঙ্গে তখন প্রবল দক্ষিণা বাতাস বইতে লাগল। ঘনকৃষ্ণ মেঘমালা চারদিক থেকে যেন পাখা মেলে এসে সারা আকাশটাকে ঢেকে ফেলল। ক্রমে আকাশটা এক কালো ছাদের মতো মেঘভারে নত হয়ে পৃথিবীর বুকের উপর চেপে বসে রইল।
তারপর শুরু হলো বৃষ্টি। সে বৃষ্টির যেন আর শেষ নেই। দিনের পর দিন ধরে চলতে থাকা সে বৃষ্টিতে এমন এক মহাপ্লাবন দেখা দিল যাতে সমগ্র পৃথিবী তার ঘর-বাড়ি, প্রাসাদ-অট্টালিকা, গ্রাম-নগর, পাহাড়-পর্বত, গাছপালা সব কিছু ডুবে গেল নিঃশেষে। কোথাও কোন কিছু চিহ্নমাত্র রইল না। চারদিকে শুধু জল আর জল। শুধু সমুদ্রের পর সমুদ্র। সেই বিশ্বব্যাপী মহাপ্লাবনের মাঝে জলের তলায় সব মানুষ তলিয়ে গেল, তাদের উচ্ছ্বসিত সব কণ্ঠ নীরব হয়ে গেল।
একমাত্র ধার্মিক নোয়ার সেই জাহাজটি ঈশ্বরের অনুগ্রহে ভেসে বেড়াতে লাগল সেই মহাপ্লাবনের মাঝে। উত্তাল জলরাশির বিক্ষুব্ধ তরঙ্গমালায় দুলে দুলে চলতে লাগল। সেই সব তরঙ্গাঘাতে তার কোন ক্ষতি হলো না।
মাইকেল এবার আদমকে জিজ্ঞাসা করল, চোখের সামনে তোমার সন্তানদের এভাবে বিলুপ্ত হয়ে যেতে দেখলে কত দুঃখ পাবে আদম। তোমার চোখে তখন হয়ত আর এক প্লাবন দেখা দেবে।
তখন দ্রুত জলের তলায় তলিয়ে যাওয়া তোমার সন্তানদের দেখতে তুমিও ঝাঁপ দেবে জলে। তারপর কোন দেবদূত এসে তুলে ধরবেন তোমায়।
আদম এবার বলল, ওঃ কী দুঃখের দৃশ্য! এর থেকে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকা অনেক ভাল ছিল। তাহলে প্রতিদিন আমার দুর্ভাগ্যের বোঝা আমি সহজেই বহন করে যেতাম। এখনকার মতো যুগ-যুগান্তকারী দুঃখের বোঝা আমাকে আমার বুকের উপর এমনি করে চেপে বসত না। অথচ ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আমার এই জ্ঞান কত নিষ্ফল, তাতে কোন লাভই হবে না। শুধু ভবিষ্যতে কি হবে সেই দুর্ভাগ্যের কথা আগে হতে জানতে পারার ফলে এক দুশ্চিন্তার দ্বারা অনুক্ষণ পীড়িত আমি।
এখন থেকে কেউ যেন ভবিষ্যতের কথা জানতে না চায়। ভবিষ্যতে তার সন্তানরা কি পরিমাণ দুর্ভাগ্যের কবলে পড়বে, তাদের ভাগ্যে কত দুঃখ আছে তা জানতে পেরে কিন্তু সে দুঃখ সে দুর্ভাগ্যকে নির্ধারিত করতে পারবে না তারা, শুধু ভয়ঙ্কর এক আশঙ্কা আর দুঃখে কাল কাটাতে হবে তাদের।
মানুষকে কোন বিষয়ে আগে হতে সতর্ক করে দেওয়ার কোন অর্থই হয় না। অল্পসংখ্যক যারা আপাতত দুর্ভিক্ষ বা দুঃখকে কোনরকমে এড়িয়ে যায়, পরে তাদের সেই দুর্ভিক্ষ ও দুঃখের কবলে পড়তে হয়।
পথিবীতে যুদ্ধের অবসান দেখে মনে আশা হয়েছিল আমার। ভেবেছিলাম এবার মানবজাতি সুখে শান্তিতে দীর্ঘকাল বাস করবে। পুনরায় এই আশার দ্বারা প্রতারিত হয়েছি আমি। এখন দেখছি যুদ্ধ যেমন ধ্বংস নিয়ে আসে মানুষের জীবনে, শান্তি তেমনি মিথ্যা ছলনার দ্বারা প্রতারিত করে মানুষকে। কেন এমন হয়? হে আমার স্বর্গীয় পথপ্রদর্শক, বল এই মহাপ্লাবনেই কি মানবজাতি বিলুপ্ত হবে সম্পূর্ণরূপে?