সেইসব তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে একটি লোক একটি শ্রমশীল কাজ করছিল। লোহা ও পিতলের দুটি চাঁই আগুনে গলিয়ে বিভিন্ন ছাঁচে ঢালছিল। সেই ছাঁচ দিয়ে সে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি তৈরি করছিল।
সেইসব তাঁবুর অন্যদিকে নিকটবর্তী যে সব পাহাড়গুলি নিচে সমতলভূমিতে নেমে এসেছিল সেখানে একদল শান্ত প্রকৃতির লোক ঈশ্বরের উপাসনা করছিল।
এদিকে তাঁবুগুলি থেকে তখন কতকগুলি পরমাসুন্দরী নারী মণি-মুক্তাখচিত পোশাক পরে বেরিয়ে এসে নানা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নাচগান করতে লাগল। কতকগুলি লোক সেই নারীদের মধ্য থেকে যাকে যাকে পছন্দ করল তাদের সঙ্গে তাদের বিবাহের ব্যবস্থা করল। বিবাহের আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম সম্পন্ন হতে লাগল ফুল, মালা ও সঙ্গীত সহযোগে।
এই দৃশ্য দেখে আনন্দ পেল আদম এবং সে আনন্দ সে প্রকাশ করল মাইকেলের কাছে। সে বলল, হে দেবদূতপ্রধান, শান্তি ও আনন্দের দ্যোতক এই দৃশ্য অনেক ভাল। আগের দুটি দৃশ্যে শুধু দেখেছি খুন আর মৃত্যুর তাণ্ডব।
মাইকেল বলল, শুধু আনন্দের মাপকাঠিতে সব কিছুর বিচার করো না। মানবজীবনের উদ্দেশ্য আরও পবিত্র হওয়া উচিত। ঈশ্বরের মনোমতো হওয়া উচিত। ঐ তবুগুলিতে তুমি যে আনন্দোচ্ছলতা দেখলে সে তাঁবুগুলি দুষ্ট প্রকৃতির লীলাভূমি। সেখানে মানবজাতির যারা বাস করে তাদের অনেকে ভাই হয়ে ভাইকে হত্যা করে। যদিও বাইরে থেকে দেখে তাদের শিক্ষিত ও মার্জিত বলে মনে হয়, তথাপি তারা একবারও তাদের পরম স্রষ্টা ঈশ্বরের কথা স্মরণ করে না, তারা ঈশ্বরের কোন দান স্বীকার করে না।
ওখানে যে সব সুন্দরী নারীদের দেখলে তারা অবশ্য অনেক সুন্দর সন্তানের জন্ম দেবে। কিন্তু তারা ধর্মবোধবিবর্জিতা নাস্তিক। তারা শুধু নাচগান ও হাসাহাসি করতে জানে। কিন্তু জানে না অল্পদিনের মধ্যেই তাদের কাঁদতে হবে।
আদম তখন বিমর্ষ হয়ে বলল, হায়! কি লজ্জা আর দুঃখের কথা। যারা একদিক দিয়ে কত ভাল জীবন যাপন করতে পারত তারা কুপথে গিয়ে অধঃপতিত হবে। এখানেও দেখছি নারী হতেই মানবজাতির দুঃখ শুরু হচ্ছে।
দেবদূত মাইকেল বলল, পুরুষদের স্ত্রৈণ মনোভাব আর দুর্বলতাই এর জন্য দায়ী। পুরুষের উচিত জ্ঞান ও শ্রেষ্ঠ গুণাবলীর দ্বারা ভূষিত হয়ে ব্যক্তিত্বসহকারে নারীদের ঠিক পথে পরিচালিত করা। এবার আর একটি দৃশ্য দেখ।
আদম তখন তাকিয়ে তার সামনে আর এক বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড দেখতে পেল। সে ভূখণ্ডে অনেক নগর ও গ্রাম রয়েছে। নগরগুলি জনবহুল, সেখানে বড় বড় সৌধ, অট্টালিকা আর উঁচু উঁচু তোরণদ্বার দেখা যাচ্ছে। বলিষ্ঠদেহী বহু সশস্ত্র যোদ্ধা ভয়ঙ্কর মুখ নিয়ে অস্ত্র সঞ্চালন করে আস্ফালন করে বেড়াচ্ছে। অশ্বারোহী কত যোদ্ধা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈনিকদের দল যখন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তখন একদল রাখাল গরু, ভেড়া ও গবাদি পশুর একটি পাল সামনের এক প্রান্তরে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। অপেক্ষমান সেনাদল তা দেখে সেই পশুপাল লুণ্ঠন করতে লাগল। রাখালরা প্রাণভয়ে পালিয়ে গিয়ে অন্য এক সেনাদলের কাছে কাতরকণ্ঠে সাহায্য প্রার্থনা করল। ফলে দুই সেনাদলের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ বাধল। দুই পক্ষেই বহু হতাহত হলো। বহু মৃতদেহ ছড়িয়ে পড়ে রইল সেই ক্ষেত্রের উপর।
তখন এক সেনাবাহিনী একটি সুরক্ষিত নগর অবরোধ করল। সেই নগরের বাইরে তারা শিবির স্থাপন করল। বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা তারা সেই নগর আক্রমণ করতে সেই নগরের সৈন্যরা বর্শা, তীর, পাথর আর অগ্নিবলয় ছুঁড়ে সে নগর রক্ষা করতে লাগল। দুপক্ষেই বহু সৈন্য নিহত হতে লাগল।
তখন সেই নগরমধ্যে নগরপরিষদের প্রবীণ সদস্য ও যোদ্ধাদের এক সভা বসল। সভা চলাকালে তাদের মধ্য থেকে একজন সহসা উঠে দাঁড়িয়ে ন্যায়, অন্যায়, ধর্ম, সত্য, শান্তি ও ঐশ্বরিক বিচার সম্বন্ধে যুক্তি দিয়ে তাদের বোঝাতে লাগল।
কিন্তু তার কথা শুনে সভাস্থিত নবীন-প্রবীণ সকল সদস্যই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল রাগে। তারা সকলে তার হাত ধরে তাকে নিগৃহীত করার জন্য টানাটানি করতে লাগল। তখন সহসা আকাশ থেকে এক মেঘখণ্ড নেমে এল এবং তার ভিতর থেকে কে যেন অদৃশ্য অবস্থায় সেই ন্যায়পরায়ণ ও সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিটিকে সকলের কাছ থেকে আশ্চর্যভাবে ছিনিয়ে নিয়ে আবার মেঘাবৃত অবস্থায় আকাশে উঠে গেল।
এই দৃশ্য দেখে চোখে জল এল আদমের। সে মাইকেলের দিকে মুখ ফিরিয়ে কাতর কণ্ঠে বলতে লাগল, এসব কি দেখছি? ওরা মানুষ নয়, মৃত্যুর দূত। ওরা মানুষ হয়ে মানুষের উপর যেরকম নিষ্ঠুর ব্যবহার করছে তাতে সেই ভ্রাতৃহন্তার পাপের থেকে দশগুণ পাপ হচ্ছে ওদের। সেই ভ্রাতৃহন্তা তার একজন ভাইকে হত্যা করছে, এরা শত শত ভাইকে হত্যা করছে। আসলে সব মানুষ সব মানুষের ভাই। এইভাবে ন্যায় অন্যায়ের দ্বারা পদদলিত হচ্ছে। যে লোকটিকে ঈশ্বর ঐন্দ্রজালিকভাবে উদ্ধার করেন ক্রুদ্ধ জনতার কবল থেকে, সেই ব্যক্তিটিই একমাত্র ন্যায় ও সত্যপরায়ণ কিন্তু ঈশ্বর তাকে উদ্ধার না করলে সে মারা যেত সেদিন।
মাইকেল বলল, এর আগে সেই প্রোদশিবিরে আনন্দোচ্ছল নাস্তিক নারীদের মধ্যে যে অশুভ অসম বিবাহ দেখেছিলে, এই সব যোদ্ধারা হলো সেই বিবাহেরই ফল। সেই সব বিবাহিত অবিমৃষ্যকারী নরনারীর সন্তান। সেই সব বিবাহিত নর-নারীর মধ্যে ভাল-মন্দ দুই-ই ছিল। তাদের মধ্যে অনেকের সে বিবাহে ইচ্ছা ছিল না। তবে বিচক্ষণতাও ছিল না। এইসব মানবিক যোদ্ধারা তাদেরই সন্তানগণ। সেকালে যুদ্ধ, বীরত্ব, শারীরিক শক্তি আর সাহসকেই মানবজীবনের সবচেয়ে বড় গুণ বলে গণ্য করত সকলে। এক জাতি যুদ্ধ ও প্রচুর নরহত্যার মাধ্যমে অন্য জাতিকে জয় করে বিজয়গৌরব লাভ করত। এইভাবে বড় বড় বীরপুরুষেরা ধ্বংসের দ্বারা গৌরব অর্জন করে যশস্বী হয়ে উঠত পৃথিবীতে।