আমাদের আদিপিতা তখন বলল, কার্য ও কারণের প্রত্যক্ষ প্রমাণসমম্বিত এই দৃশ্য। কিন্তু মৃত্যু কি জিনিস তা আমি স্বচক্ষে এখন প্রত্যক্ষ করলাম। কী ভয়াল এই দৃশ্য! এ দৃশ্য চোখে দেখা, এর কথা ভাবা বা অনুভব করা খুবই ভয়ঙ্কর।
মাইকেল বলল, মানুষের উপর নেমে আসা মৃত্যুর প্রথম রূপ তুমি প্রত্যক্ষ করলে। কিন্তু মৃত্যুর আরও অনেক রূপ আছে। অনেক ভাবেই মানুষ মৃত্যুবরণ করে সমাধিগহ্বরে যায়। কিন্তু মৃত্যুর সব রূপই ভয়াবহ। তবে মৃত্যুর দৃশ্য বা চিন্তা যত ভয়াবহ, আসল মৃত্যু তত ভয়াবহ নয়। তুমি যেমন দেখলে, অনেকে মর্মান্তিক আঘাতে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, অনেকে আবার অগ্নিকাণ্ড, বন্যা, দুর্ভিক্ষ ও খাদ্য বা পানীয়জনিত ব্যাধির কবলে পড়ে মারা যায়। ভয়ঙ্কর ব্যাধিতে আক্রান্ত বহু মানুষের দৃশ্য এখনি আবির্ভূত হবে তোমার সামনে। তখন জানতে পারবে ঈভের পাপ মানবজাতির উপর কি দুঃখই না নিয়ে এসেছে।
তখনি এক অন্ধকার স্থান তারা দেখতে পেল। সেখানে অনেক রোগগ্রস্ত ব্যক্তি শায়িত ছিল। সকলেই ভয়ঙ্কর এক একটি রোগে ভুগছিল। কেউ মাথার যন্ত্রণায়, কেউ পেটের যন্ত্রণায়, কেউ জ্বরে, কেউ আঘাতজনিত ক্ষতের যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে করতে ছটফট করছিল। তাদের মধ্যে উন্মাদরোগগ্রস্ত ব্যক্তিও ছিল।
বিজয়ী বীরের মতো মৃত্যু তার অব্যর্থ বাণটি দিয়ে তার শেষ আঘাত তখনো হানেনি, শুধু বাণটি তাদের উপর ভয়ঙ্করভাবে দেখাচ্ছিল। যে মৃত্যু তাদের একমাত্র মঙ্গল, মুক্তি ও আশা-ভরসা, সে মৃত্যু লাভ করতে পারছিল না তারা। শুধু দীর্ঘায়িত হয়ে চলেছিল তাদের দুঃসহ মৃত্যু-যন্ত্রণা। কোন প্রস্তরকঠিন হৃদয়বিশিষ্ট ব্যক্তিও অশ্রুশূন্য শুষ্ক চোখে সে দৃশ্য দেখতে পারে না।
সে দৃশ্য চোখে দেখতে পারল না, দুঃখে অভিভূত হয়ে কাঁদতে লাগল আদম। সে কোন নারীর গর্ভজাত সন্তান না হলেও করুণায় বিগলিত হয়ে উঠল তার অন্তর। সে করুণা অশ্রু হয়ে ঝরে পড়তে লাগল তার চোখ থেকে। তবু দৃঢ় চিন্তার দ্বারা তার আবেগাতিশয্যকে সংযত করে আদম বলতে লাগল, হেহতভাগ্য দুঃখী মানবজাতি! কী শোচনীয় তোমার অধঃপতন, কী ভয়ঙ্কর দুরবস্থাই না তোমার ভাগ্যে আছে। এই হতভাগ্য মানবজাতির জনক না হয়ে এখানেই আমার মৃত্যু হলে ভাল হত। মানবজাতির জন্ম না হওয়াই উচিত ছিল।
এ জীবন কেন আমাদের দান করা হলো যদি তা এমন ভয়ঙ্করভাবে ছিনিয়ে নেওয়া হবে আমাদের কাছ থেকে? কেন এ জীবনকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হলো আমাদের উপর? যদি জানতাম এ জীবনের পরিণতি এই তাহলে জন্মকালে এ জীবন গ্রহণ করতাম না অথবা তখনি এ জীবনের শান্তিপূর্ণ অবসান প্রার্থনা করতাম। তাহলে দুঃখ পেতে হত না।
যে মানুষ একদিন ঈশ্বরের প্রতিরূপ হিসাবে কত সুন্দরভাবে সৃষ্ট হয়েছিল, সে মানুষ পাপগ্রস্ত হয়ে কেন এই অদর্শনীয় অবর্ণনীয় দুঃখ-যন্ত্রণার শিকার হবে? স্রষ্টার প্রতিরূপের খাতিরে মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের গুণ ও কিছু অংশ অন্তত থাকবে যে গুণ ও শক্তি বলে সে এই সব দেহগত ব্যাধি ও বিকৃতির হাত হতে মুক্তি পাবে।
মাইকেল তখন উত্তর করল, যখন তারা তাদের অসংযত ক্ষুধাকে তৃপ্ত করার জন্য পাপ করে তখনি স্রষ্টার প্রতিমূর্তি তাদের ত্যাগ করে। তখন ঈভের পাপজনিত কলুষিত কামনার প্রতিমূর্তি গ্রহণ করে তারা। তাই তার এই শাস্তি।
তারা পাপকর্মের দ্বারা ঈশ্বরের প্রতিমূর্তিকে বিকৃত করেনি, করেছে তাদের নিজেদেরই মূর্তিকে, হারিয়েছে ঈশ্বরের গুণাবলীকে। পবিত্র প্রকৃতির শুভ নিয়মগুলিকে লঙঘন করে তারা ঘৃণ্য কামনা ও দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে। তারা ঈশ্বরের প্রতি সব শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে।
আদম বলল, আমি সব স্বীকার করি। ঐশ্বরিক বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া অন্য কোন পথ নেই। এইসব যন্ত্রণাদায়ক পথ ছাড়া মৃত্যুর কাছে যাবার বা সমাধিগহ্বরের মাটিতে মিশে থাকার অন্য কোন পথ নেই।
মাইকেল বলল, হ্যাঁ আছে। যদি তুমি সব কিছুর ‘অতি’কে পরিহার করে চলতে পার, যদি তুমিও পরিমিত পানাহারের মধ্য দিয়ে উপযুক্ত পুষ্টি লাভ করতে পার তাহলে দীর্ঘজীবন লাভ করতে পারবে তুমি। তাহলে অকালে নির্দয়ভাবে তোমার জীবনবৃক্ষ হতে ছিন্ন হবে না তুমি। যথাসময়ে বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুবরণ করবে তুমি। তাহলে যৌবন পার হয়ে বার্ধক্য পর্যন্ত বাঁচতে পারবে তুমি। যৌবনের সব শক্তি সব সৌন্দর্য বার্ধক্যের মধ্যে এসে শুকিয়ে যায়। তখন সব ইন্দ্রিয়শক্তিগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে। বাঁচার সব আনন্দ, সব উদ্যম এক নিবিড়তম হতাশা আর বিষাদে পরিণত হয়। স্তিমিত হয়ে পড়ে আত্মার সব শক্তি। অবশেষে অবসান হয় জীবনের।
তখন আদিপিতা বলল, এখন থেকে আমি আর মৃত্যুর কাছ থেকে পালিয়ে যাব না। আর জীবনকে দীর্ঘায়িত করব না। আমি শুধু মৃত্যুর সহজ ও সুন্দর উপায়টা জানতে চাই। আমি ধৈর্য ধারণ করে মৃত্যুকে বরণ করে নিতে চাই।
মাইকেল বলল, জীবনকে খুব বেশি ভালবাসবে না, আবার খুব বেশি ঘৃণাও করবে না। যে জীবন যাপন করবে তা ভালভাবে সম্ভবে যাপন করবে। সে জীবন দীর্ঘ হবে না সংক্ষিপ্ত হবে তা ঈশ্বরের হাতে ছেড়ে দাও। এখন অন্য এক দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত হও।
আদম তার সামনে তাকিয়ে এক প্রশস্ত সমতলভূমি দেখতে পেল। সে ভূমিতে বিভিন্ন রঙের তাঁবু ছিল। কয়েকটি তাঁবুর পাশে গবাদি পশুর পাল চরে বেড়াচ্ছিল। অন্য কতকগুলি তাবু থেকে বীণা, অর্গান ও কতকগুলি বাদ্যযন্ত্রের সমন্বিত সঙ্গীতের সুর ভেসে আসছিল। সে সুরলহরী উচ্চ ও নিম্নগ্রামে ওঠানামা করছিল।