তবে অবশ্য এটা তোমার রাজধানী হতে পারত যেখান থেকে মানবজাতি সমগ্র পৃথিবীতে বিস্তারলাভ করতে পারত এবং মাঝে মাঝে পৃথিবীর বিভিন্ন দিক থেকে দলে দলে মানুষ এসে তাদের মহান আদিপিতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে যেতে পারত। কিন্তু সে সুযোগ তুমি হারিয়েছ। এখন তোমাকে পৃথিবীর সমতলভূমিতে গিয়ে বসবাস করতে হবে। সেখানেই তোমার সন্তানদের জন্ম হবে। তবে এটা জানবে, পৃথিবীর সব উপত্যকা ও সমতলভূমির সর্বত্রই ঈশ্বর আছেন। তুমি তাঁর পদধ্বনি শুনতে পাবে। এ বিষয়ে স্থির বিশ্বাস রাখবে, কোন সংশয় করবে না।
কিন্তু এখান থেকে তোমাদের প্রস্থানের পূর্বে তোমাদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কিছু কথা বলতে চাই আমি। আর এর জন্যই আমাকে পাঠানো হয়েছে। তোমার ও তোমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেই আমি কিছু বলতে চাই। ভাল-মন্দ দুই-ই শোনার জন্য প্রস্তুত থাকবে। ধৈর্য ধারণ করে আনন্দ ও বেদনার সঙ্গে জানতে পারবে মানুষের পাপপ্রবৃত্তি, পাপাসক্তি ও ঈশ্বরের পরম করুণার কথা। সুখে-দুঃখে, উন্নতি ও অবনতির মধ্য দিয়ে তোমার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবে তুমি। তুমি ঐ পাহাড়ে উঠে যাও, ঈভ কি নীচেতেই নিদ্রা যাবে?
আদম এবার কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলল, হে আমার পথপ্রদর্শক, তুমি আগে ওঠ, আমি নিরাপদে তোমার অনুসরণ করব। তুমি যে পথে নিয়ে যাবে সেই পথেই যাব আমি। ঈশ্বরের হাতে সমর্পণ করেছি আমি নিজেকে। যতই দুঃখ আসুক, নীরব নির্বিবাদ দুঃখভোগের দ্বারা সব দুঃখকে জয় করব আমি। বিশ্রামের দ্বারা অপনোদন করব শ্রমের সব ক্লান্তি।
দুজনে সেই পাহাড়ে আরোহণ করতে লাগল দূরস্থিত ঈশ্বরের দৃষ্টির সম্মুখে।
সেটি ছিল মর্ত্যলোকের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় যার শিখরদেশ হতে পৃথিবীর সুদূরপ্রসারিত গোলার্ধ দুটি পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছিল। সেখান থেকে আদমকে পৃথিবীকে ভালবাসার বিভিন্ন কারণগুলি দেখানো হচ্ছিল।
সেই পর্বতশিখরে দাঁড়িয়ে যেদিকেই দৃষ্টিপাত করছিল আদম সেই দিকেই সেই বিশাল পৃথিবীর অতীত ও বর্তমানের কত গৌরবময় রাজ্য ও ঐশ্বর্যগুলি দেখতে পাচ্ছিল। সে দেখল, চীনসম্রাট খানের রাজধানী সমরখন্দ, মোগলদের রাজধানী আগ্রা ও লাহোর, পারস্যের রাজধানী ইস্পাহান, রুশসম্রাট জারের রাজধানী মস্কো এবং তাছাড়া ইউরোপ, আফ্রিকা ও আমেরিকার বিভিন্ন ঐতিহ্যমণ্ডিত রাজ্য ও রাজধানী।
কিন্তু তার থেকে মহত্তর দৃশ্য দেখাবার জন্য আদমের দৃষ্টি সেখান থেকে ফিরিয়ে অন্যদিকে নিবদ্ধ করল মাইকেল। তাকে এখন আরও অনেক কিছু দেখতে হবে। তাই তার দৃষ্টিশক্তিকে আরও স্বচ্ছ ও চোখের স্নায়ুগুলিকে আরও শক্তিশালী করার জন্য জীবনের কূপ থেকে তিন ফোঁটা জল পড়ল।
এই জলবিচ্ছুরিত শক্তি এত জোরাল ছিল যে আদমের চক্ষু মুদ্রিত হয়ে গেল আপনা থেকে, তার অন্তরাত্মা আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে এক তন্দ্রাবেশে, সে মাটিতে ঢলে পড়ল। তখন মাইকেল তাকে তুলে ধরে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, এখন তোমার চক্ষু উন্মীলিত করো আদম। প্রথমে দেখ, তোমার থেকে যারা উদ্ভূত হবে তাদের উপর তোমার আদিম পাপের প্রতিক্রিয়া। যারা কখনো তোমার মত সেই নিষিদ্ধ ফলের বৃক্ষকে স্পর্শ করেনি, যারা সেই সর্পরূপী শয়তানের দ্বারা প্ররোচিত হয়নি, যারা কখনো কোন পাপকর্ম করেনি, তারা তোমার কৃত পাপকর্মের প্রভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে কত ভয়ঙ্কর পাপকর্মের অনুষ্ঠান করবে।
আদম এবার চোখ খুলে একটি মাঠ দেখতে পেল। সেই মাঠের একটি অংশ ছিল কর্ষিত ও কৃষিযোগ্য। তাতে ফসল কাটা হচ্ছিল। আর একটি অংশ ছিল অকর্ষিত তৃণভূমি, তাতে মেষ চরে বেড়াচ্ছিল।
সেই মাঠের মাঝখানে একটি ঘাসে ঢাকা বেদী ছিল। সেখানে এক শস্যকৰ্ষণকারী তার চাষের জমি থেকে তার প্রথম ওঠা পাকা ফসল নিয়ে এল। তারপর এক নিরীহ ও শান্তপ্রকৃতির রাখাল এক নবজাত মেষশিশু নিয়ে এসে তাকে বলি দিল দেবতার উদ্দেশ্যে। চর্বিসহ বলির মাংস আগুনে ঝলসিয়ে নিবেদন করল দেবতাকে। দেবতা আকাশে আকাঙিক্ষত বিদ্যুৎ চমকানির দ্বারা সেই বলির দান গ্রহণ করলেন। কারণ তার আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম যথাযথভাবে সম্পন্ন হয়েছিল।
কিন্তু অন্যজনের আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম ঠিকমত সম্পন্ন না হওয়ায় তার পূজার অঞ্জলি ও উপাচার গ্রহণ করলেন না দেবতা। তখন সে রেগে গিয়ে সেই রাখালের সঙ্গে উত্তপ্তভাবে তর্কবিতর্ক করতে লাগল। একসময় সে একটি পাথর দিয়ে রাখালের মাথায় জোর আঘাত করায় তার মাথা থেকে প্রচুর রক্ত ঝরতে লাগল এবং সে তৎক্ষণাৎ মাটিতে পড়ে গিয়ে মারা গেল।
এই দৃশ্য দেখে ভীত হয়ে পড়ল আদম। সে মাইকেলকে বলল, হে আমার গুরুদেব, নিরীহ ব্যক্তিটি ভক্তিসহকারে ধর্মসম্মতভাবে বলির ক্রিয়া সম্পন্ন করলেও তার কি মারাত্মক ক্ষতিই না হলো।
দেবদূতপ্রধান মাইকেলও তখন বিচলিত হয়ে বলল, এই দুই ব্যক্তি দুই ভাই, তোমারই বংশোদ্ভুত সন্তান। অন্যায়কারী ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিটিকে হত্যা করল। কারণ তার ভাই-এর পূজা উপচার দেবতা গ্রহণ করায় ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে সে তার প্রতি। কিন্তু ঈশ্বর এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ গ্রহণ করবেন এবং ন্যায়বান ব্যক্তিটি রক্তাক্ত ও মৃত অবস্থায় এখন মাটিতে পড়ে থাকলেও সে তার ধর্মাচরণের পুরস্কার পাবে।