আদম নত হয়ে অভিবাদন জানাল মাইকেলকে। কিন্তু তার পদমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবার ভয়ে কিছুই বলল না সে বা হাবভাবেও কিছু প্রকাশ করল না।
মাইকেল এবার তার আসার কারণ কোন ভূমিকা না করেই ব্যক্ত করল। সে বলল, ঈশ্বরের বিধান প্রকাশ করতে কোন ভূমিকার দরকার হয় না। তোমাদের প্রার্থনা ঈশ্বর শুনেছেন। যার ফলে তোমরা তাঁর বিধি লঙ্ঘন করার পর অনেক দিন কেটে গেলেও মৃত্যু তোমাদের গ্রাস করতে পারেনি। ইতিমধ্যে তোমরা অনেক অনুতাপ ভোগ করেছ। অনেক সময় অনেক সৎকর্মের দ্বারা একটি পাপকর্মের গুরুত্ব লঘু হয়ে যায়। ঈশ্বর তাই সন্তুষ্ট হয়ে মৃত্যুদণ্ড হতে তোমাদের মুক্তি দিয়েছেন। কিন্তু তিনি তোমাদের আর এই স্বর্গোদ্যানে বাস করার অনুমতি দেবেন না। তোমাদের এখানে থেকে স্থানান্তরিত করার জন্য আমি এসেছি। তোমাদের এখান থেকে সেই ভূমি কর্ষণের জন্য পাঠানো হবে যেখান থেকে উদ্ভূত হয়েছ তোমরা।
আর কিছু বলল না মাইকেল। কারণ এই সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে মর্মাহত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল আদম। তার সমস্ত ইন্দ্রিয় অভিভূত হয়ে পড়ল। ঈভ একটু দূরে থাকলেও একথা শুনতে পেল।
ঈভ তখন বিলাপ করতে লাগল, ওঃ কি অপ্রত্যাশিত আঘাত! এ আঘাত মৃত্যুর থেকেও ভয়ঙ্কর। আমাকে কি এই সাধের স্বর্গোদ্যান ছেড়ে চলে যেতে হবে? যে স্থানে জন্মের পর থেকে বর্ধিত হয়েছি আমরা, যেখানকার ছায়াচ্ছন্ন বনপথে কত আনন্দে ভ্রমণ করেছি, যা দেবতাদেরও প্রমোদভ্রমণের উপযুক্ত সে স্থান ছেড়ে যেতে হবে আমাদের চিরতরে? সব দুঃখ সত্ত্বেও এখানে আমাদের মরণশীল জীবনযাপনের কত আশা করেছিলাম আমরা। হে পুষ্পনিচয়, তোমরা অন্য কোন স্থানে অন্য জলবায়ুতে জন্মাতে না। তোমাদের মধ্যে কুঁড়ি ফুটিয়ে তুলেছি, তোমাদের নামকরণ করেছি। কে তোমাদের এবার হতে লালন করবে, কে ঝর্ণা থেকে জল এনে সেচন করবে তোমাদের? হে আমাদের বাসরকুঞ্জ, তোমাকে নিজের হাতে সাজিয়ে বর্ণগন্ধময় করে তুলেছি। কত মধুর মনোহর করে তুলেছি, কেমন করে তোমাদের ছেড়ে যাব? কোন অজানা অচেনা হীন জগতে গিয়ে আমরা ঘুরে বেড়াব, কোন অপবিত্র বাতাসে নিঃশ্বাস নেব? যে সব ফল খেতে আমরা অভ্যস্ত সে ফল কোথায় পাব?
দেবদূত মাইকেল ঈভকে থামিয়ে দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলতে লাগল, দুঃখ করো না ঈভ। ধৈর্যসহকারে সব ক্ষতি সহ্য করো। যা তোমার নয় তা নিয়ে আবেগের সঙ্গে শোক করো না। তুমি একা কোথাও যাচ্ছ না। তোমার স্বামীও যাবে তোমার সঙ্গে। যেখানে গিয়ে তোমরা বাস করবে সেটাকেই তোমাদের জন্মভূমি ভাববে।
আদম এবার তার দুঃখের আবেগটা সামলে নিয়ে বিনয়ের সঙ্গে মাইকেলকে বলল, হে আমার স্বর্গীয় অতিথি, তোমার আকৃতি দেখে যা মনে হয় তুমি দেবদূতদের মধ্যে সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত। তুমি ঈশ্বরপ্রেরিত সংবাদ শান্তভাবে সহানুভূতির সঙ্গে ব্যক্ত করেছ আমাদের কাছে। অন্য কেউ এই ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ কঠোরভাবে আমাদের বললে দুঃখ, বিষাদ ও হতাশাজর্জরিত আমাদের হৃদয় হয়ত তা সহ্য করতে পারত না। এখানেই হয়ত প্রাণত্যাগ করতে হত আমাদের।
তুমি সংবাদ এনেছ, এই মনোরম স্থান, মনোহর উদ্যান যা আমাদের শত দুঃখের মধ্যে ছিল একমাত্র সান্ত্বনার বস্তু ও একমাত্র আশ্রয়স্থল তা চিরতরে ছেড়ে চলে যেতে হবে আমাদের। এই স্থান ছিল আমাদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত। অন্য যে কোন স্থানই আমাদের অপরিচিত এবং শূন্য ও পরিত্যক্ত মনে হবে।
যদি অবিরাম প্রার্থনার দ্বারা তাঁর ইচ্ছা ও বিধানের পরিবর্তন সাধন করা সম্ভব হত, তাহলে আমার ক্রমাগত অকাতর ক্রন্দন ও প্রার্থনার দ্বারা তাঁর কর্ণকুহর ক্লান্ত করে তুলতাম। কিন্তু প্রতিকূল নিঃশ্বাসের দ্বারা যেমন কোন অবাঞ্ছিত বায়ুপ্রবাহের গতিরোধ করতে পারা যায় না তেমনি প্রার্থনার দ্বারা তাঁর অমোঘ অখণ্ডনীয় বিধানেরও গতিরোধ করা যায় না। সুতরাং তাঁর অমোঘ বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করলাম আমি।
আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ এই যে, এখান থেকে অন্য কোথাও গেলে ঈশ্বরের পবিত্র মুখদর্শন হতে বঞ্চিত হব আমি। এখানকার বিভিন্ন স্থানে তার উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করতাম। এই পর্বতের উপর তিনি একবার আবির্ভূত হয়েছিলেন, এই বৃক্ষতলে তিনি একবার দাঁড়িয়ে ছিলেন, এইসব পাইন গাছের মধ্যে তাঁর কণ্ঠস্বর শুনেছিলাম, ঐ ঝর্ণার ধারে তাঁর সঙ্গে একদিন কথা বলেছিলাম। আমার সন্তান-সন্ততিদের কাছে পরে একথা বলতে পারতাম।
এখানে আমি মাটি দিয়ে কত বেদী নির্মাণ ও নদীর বুক থেকে পাথর এনে কত মন্দির নির্মাণ করে ফল-ফুল দিয়ে তাঁর পুজো করতে পারতাম। কিন্তু ঐ অজানা জগতে গিয়ে কোথায় খুঁজে পাব তার উজ্জ্বল উপস্থিতি? কোথায় দেখতে পাব তাঁর পদচিহ্ন? যদিও আমি আমার কৃত পাপকর্মের দ্বারা তাঁকে ক্রুদ্ধ করে তুলেছি তথাপি তিনি আমাকে দীর্ঘ জীবন দান করেছেন এবং আমার থেকে এক নূতন জাতির উদ্ভব হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাই আমি আজও দূর থেকে তাঁর বিরাট গৌরবের ধ্বজা দেখতে পাই, তার দূরাগত পদধ্বনি শুনতে পাই।
একথা শুনে মাইকেল বলল, আদম, তুমি কি জান না শুধু এই পাহাড় বা উদ্যান নয়, স্বর্গ, মর্ত্যের যেখানে যত পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র, জল-বাতাস, জড় ও জীব আছে, ঈশ্বর তাদের সবার মধ্যে বিরাজ করছেন। কোথায় নেই তিনি? তারই দেওয়া প্রাণের উত্তাপে সব জীব উত্তপ্ত। পৃথিবীকেই তিনি তোমার অধিকারে ছেড়ে দিয়েছেন। একি কম দান? সুতরাং এই ইডেন উদ্যানের সংকীর্ণ সীমার মধ্যে তাঁর সর্বব্যাপী উপস্থিতিকে খণ্ড খর্ব করে দেখোনা।