আমি যখন থেকে নতজানু হয়ে আমার অখণ্ড একনিষ্ঠ অন্তর হতে স্বতোৎসারিত প্রার্থনার দ্বারা রুষ্ট দেবতাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেছি তখন থেকেই মনে হয়েছে আমি যেন আমার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি ঈশ্বর শান্ত হয়ে উৎকর্ণ হয়ে আমার– প্রার্থনা শুনছেন। আমার মনে হয়েছে, আমি তার অনুগ্রহবাক্য শুনতে পাচ্ছি। আমার। অশান্ত বুকে তখন শান্তি নেমে এসেছে। তোমার সন্তান-সন্ততিরা আমাদের শত্রুর মাথায় আঘাত করবে–ঈশ্বরের এই প্রতিশ্রুতিবাক্য স্মরণপথে উদিত হয়েছে আমার।
তখন ভয়ে একথা মনে স্থান পায়নি আমার। কিন্তু এখন বুঝছি এবং এই ভেবে আশ্বস্ত হচ্ছি যে মৃত্যুর ভয়াল তিক্ততা এখন অতিক্রান্ত এবং আমরা বেঁচে থাকব। এখন তোমাকে সম্ভাষণ জানাই। সত্যিই তুমি মানবজাতির আদি মাতা। তোমার জন্যই মানবজাতি বেঁচে থাকবে।
ঈভ কিন্তু একথায় উৎফুল্ল না হয়ে বিষণ্ণভাবে বলতে লাগল, আমার মত এক বিধির বিধান লঙ্ঘনকারিণী কখনই এ নাম এ উপাধির যোগ্য নয়। যে তোমার ভাল করতে গিয়ে তোমার ফাঁদে পরিণত হয়, ভর্ৎসনা, অবিশ্বাস এবং নিন্দাই তার প্রাপ্য।
কিন্তু অনন্ত ক্ষমাগুণসম্পন্ন পরম করুণাময় বিচারক এই বিধান দেন যে, যে সমগ্র মানবজাতির উপর মৃত্যুর খঙ্গকে ঝুলিয়ে দিয়েছে সে-ই হবে সমস্ত মানব জীবনের উৎস। আর তুমিও তাই আমাকে অন্য নামের পরিবর্তে আদি মানবমাতার উপাধিতে ভূষিত করলে।
সে যাই হোক, মাঠের শ্রমশীল কাজ আমাদের ডাকছে। আমরা গতকাল বিনিদ্র রাত্রি যাপন করলেও প্রভাতকাল উপস্থিত হয়েছে। আমরা নৈশ বিশ্রামলাভে বঞ্চিত হলেও এই প্রভাত তার হাস্যোজ্জ্বল গোলাপী আলোর ছটা বিকীর্ণ করে এগিয়ে চলেছে। এখন থেকে সারাদিন আমরা যেখানেই কাজ করি না কেন, তোমার কাছ ছেড়ে আর কোথাও যাব না আমি। আমরা একসঙ্গে কাজ করে একসঙ্গে হেঁটে যে আনন্দ পাই তাতে কোন শ্রমই কষ্টকর মনে হবে না আমাদের। আমাদের পতন সত্ত্বেও এই দুরবস্থার মধ্যে পতিত হলেও আমরা পরস্পরকে ভালবাসি–এটা আমাদের পরম তৃপ্তি ও আনন্দের কথা।
বিনয়ের সঙ্গে এই কথাগুলি বলল ঈভ। কিন্তু তাদের নিয়তি এ কথায় সায় দিল না। প্রথমে প্রকৃতিজগতে কয়েকটি লক্ষণ দেখা গেল। ক্রমে পশু, পাখি ও বাতাসের উপর তার প্রতিক্রিয়া দেখা গেল। সকালের কিছু পরেই বাতাস স্তব্ধ হয়ে। গেল। আকাশ অন্ধকার হয়ে উঠল।
ঈভের চোখের সামনে জোতের পাখি সুন্দর আকাশ থেকে নেমে আসতে লাগল। আদমের সামনে দিয়ে উজ্জ্বল পালকবিশিষ্ট দুটি পাখি উড়ে গেল। যে পশু বনের মাঝে হিংসা ভুলে থাকত সেই পশু বনের সবচেয়ে এক শান্ত প্রাণীকে শিকারীর মত তাড়া করে পূর্বদিকে ছুটে গেল। তা দেখে আদম কোনরূপ বিচলিত না হয়েই ঈভকে বলল, শোন ঈভ, আমাদের ভাগ্যের উপর কোন এক নূতন পরিবর্তন আসন্ন। ঈশ্বর হয়ত প্রকৃতিজগতের কয়েকটি নিরুচ্চার নীরব লক্ষণের মাধ্যমে তাঁর উদ্দেশ্যের কথা পরিব্যক্ত করছেন। তিনি হয়ত শাস্তি থেকে আমাদের অব্যাহতি দিতে চান এবং এ বিষয়ে সতর্ক করে দিতে চাইছেন আমাদের। কারণ এভাবে আর কতদিন আমাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী না হয়ে দীর্ঘায়িত হবে, কতদিন আমাদের জীবন মাটিতে মিশে না গিয়ে এইভাবে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুভয়ে শঙ্কিত হয়ে থাকবে?
কেন আমরা একই সঙ্গে একই সময়ে দুটি করে বস্তু দেখছি? দেখছি দুটি করে পাখি আর পশু? বেলা দ্বিপ্রহর না হতেই পূর্বদিকে অন্ধকার নেমে আসছে কেন আর পশ্চিম দিকের নীল আকাশে প্রভাতের আলো উজ্জ্বলতর ও শুভ্রতর দেখাচ্ছে কেন? মনে হচ্ছে এক শুভ্র মেঘের আকারে এক স্বর্গীয় জ্যোতিপুঞ্জ নেমে আসছে।
আদমের দেখতে সত্যিই ভুল হয়নি। কারণ তখন সত্যিই স্বর্গ থেকে দেবদূতের দল মর্ত্যলোক অভিমুখে নেমে আসছিল। তারা প্রথমে একটি পাহাড়ের উপর নামল। সংশয় আর শঙ্কায় আদমের চোখের দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল বলে সেই দেবদূতদের দেখতে পেল না আম।
প্রধান দেবদূত মাইকেল এবার তার সহকারীদের স্বর্গোদ্যানের দখল নেবার জন্য পাঠিয়ে দিয়ে নিজে একা আদম কোথায় তা দেখতে লাগল।
আদম তাকে দেখতে পেয়ে এবং সেই দেবদূত-অতিথিকে সেদিকে আসতে দেখে ঈভকে বলল, ঈভ, স্বর্গ থেকে কোন বড় খবর আসছে আমাদের জন্য। হয়ত ঈশ্বর কোন নৃতন বিধান জারি করেছেন। কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি শুভদ্রাজ্জ্বল যে মেঘখণ্ডটি এতক্ষণ ঐ নিকটবর্তী পাহাড়টিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল সেই মেঘখণ্ড হতে একজন স্বর্গীয় দেবসেনা বেরিয়ে আসছেন। তাকে দেখে কোন নিম্নস্তরের দেবদূত বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ঈশ্বরের কোন উচ্চপদমর্যাদাসম্পন্ন প্রতিনিধি। তবে তার আকৃতির মধ্যে ভয়ঙ্কর কিছু নেই যাতে আমি ভয় করতে পারি। আবার রাফায়েলের মত তিনি শান্ত বা সামাজিক নন, যাঁকে আমি খুব অন্তরঙ্গ বলে ভাবতে পারি। তিনি গম্ভীর এবং মহান যাতে তিনি আমার উপর রুষ্ট না হন তার জন্য এগিয়ে গিয়ে আমি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে সাক্ষাৎ করি তাঁর সঙ্গে। তুমি এখন যাও।
আদমের কথা শেষ হতেই প্রধান দেবদূত মাইকেল তার কাছে এগিয়ে এল। তবে অলৌকিক কোন দৈব রূপ ধারণ করে নয়, মানুষের রূপেই দেখা করতে এল মানুষের সঙ্গে। তার বাহুর উপর দিকে ছিল প্রাচীনকালের রাজারাজড়া ও বীরপুরুষদের দ্বারা পরিহিত এক সামরিক অলঙ্কার। সেলিবিয়ার লোকদের দ্বারা পরিহিত নীল সামরিক অলঙ্কার থেকেও উজ্জ্বল ছিল মাইকেলের সে অলঙ্কার। তার নক্ষত্রখচিত শিরস্ত্রাণটি মাথা থেকে খুলতেই দেখা গেল যৌবনকাল শেষ হয়ে গেলেও অনন্ত অফুরন্ত যৌবন বিরাজ করছে। তার কটিদেশে একটি তরবারি আর হাতে ছিল একটি বর্শা।