কিন্তু কোন্ প্রতিশোধ তারা গ্রহণ করতে চায়? স্বর্গের দুর্গকারগুলি অগণিত সশস্ত্র সৈনিকদের দ্বারা পরিপূর্ণ। দুর্ভেদ্য সেই দুর্গদ্বারে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য। স্বর্গলোকের সীমান্তবর্তী নিম্নাঞ্চলগুলিতেও আছে অসংখ্য সৈন্যশিবির। এমন কি রাত্রির অন্ধকারেও অসংখ্য পক্ষবিশিষ্ট দেবসেনা দূর দূরান্ত পরিভ্রমণ করে প্রহরা দিয়ে চলেছে এবং তাদের প্রতি সদাসতর্ক দৃষ্টি রেখে চলেছে।
অথবা যদি আমরা বলপ্রয়োগের দ্বারা সেখানে প্রবেশ করি, যদি নরকপ্রদেশের সমস্ত অধিবাসী অভিযানে যোগদান করে এবং যদি আমরা আমাদের সম্মিলিত দেবদ্রোহিতার কৃষ্ণকুটিল ও নারকীয় অন্ধকারের দ্বারা স্বর্গলোকের পবিত্র জ্যোতিপুঞ্জকে ম্লান করে দিতে চাই, তাহলেও আমাদের প্রধানতম শত্রু ঈশ্বর অম্লান ও অক্ষত অবস্থায় অধিষ্ঠিত হয়ে থাকবে তার সিংহাসনে। আমাদের সকল অভিযান ও সমরোদ্যমকে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে দিয়ে অপরাজেয় রয়ে যাবে সেই স্বর্গলোক।
এইভাবে যদি আমরা প্রতিহত হই সে যুদ্ধে, তাহলে ভূমিসাৎ হয়ে যাবে আমাদের সকল আশার উত্তঙ্গ সৌধ। আর তার ফলে সর্বশক্তিমান বিজেতা ঈশ্বরের ক্রোধাবেগ হবে বর্ধিত। সে তখন তার ক্রোধের সেই প্রচণ্ডতা আমাদের উপর প্রয়োগ করে সমূলে বিনাশ করবে আমাদের। আমাদের উপরে অকালে নেমে আসবে এক শোচনীয় পরিণতি।
তাহলে আসলে ক্ষতিটা কার হবে? মৃত্যুর অন্ধকার গর্ভে চিরতরে বিলীন হয়ে যাওয়ার থেকে এই নরকযন্ত্রণা ভোগ করে যাওয়া অনেক ভাল। আমাদের বুদ্ধি আর চিন্তাশক্তি আছে। আমাদের চিন্তাভাবনাকে অনন্ত প্রসারিত করে দিতে পারি।
কে জানে, এইখানে এইভাবে থাকাটাই হয়ত মঙ্গলজনক আমাদের পক্ষে। আমাদের ক্রুদ্ধ শত্রু ঈশ্বর আমাদের জন্য যে মঙ্গলের বিধান কোনদিনই করবে না, সে মঙ্গল আমাদের এখান থেকেই খুঁজে নিতে হবে। কিন্তু আমরা যদি আমাদের উদ্ধত কামনাকে পূরণ করার জন্য যুদ্ধ করি সে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে তাহলে অনন্তকাল ধরে শাস্তিভোগ করে যেতে হবে আমাদের।
যারা যুদ্ধ চায় আমাদের মধ্যে তারা বলতে পারে যুদ্ধ করে স্বর্গলোক অধিকার না করলে অনন্তকাল ধরে আমাদের এখানে দুঃখ ভোগ করে যেতে হবে। কিন্তু যেভাবে আমরা আছি এখন এখানে তাতে দুঃখ-কষ্ট কোথায় তা বুঝতে পারছি না। কিসের কষ্ট? এই যে আমরা বসে আছি, স্বাধীনভাবে আলোচনা করছি, সশস্ত্র অবস্থায় স্বাধীনভাবে বিচরণ করছি, এটাই যথেষ্ট নয় কি? কিন্তু আমরা যদি যুদ্ধ করতে গিয়ে দেবতাদের নিক্ষিপ্ত বজ্ৰদ্বারা তাড়িত হয়ে ক্রমাগত পালিয়ে বেড়াই এবং অবশেষে এই নরকের মত অন্ধকার গর্ভে আশ্রয় গ্রহণ করি আঘাত থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য, অথবা যদি শৃঙ্খলিত অবস্থায় জ্বলন্ত হ্রদে নিমজ্জিত হয়ে থাকতে হয় তাহলে সেটা কি আরো খারাপ হবে না?
আমাদের দগ্ধ করার জন্য যে অশুভ অগ্নি একদিন প্রজ্জ্বলিত হয় তার নিঃশ্বাসে, আজ আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করলে তার প্রচণ্ড ক্রোধাবেগে তপ্ত সেই নিঃশ্বাস থেকে আগের থেকে সাতগুণ বেশি জ্বলবে। আবার সে তার চরম প্রতিশোধ বাসনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে প্রসারিত করে দেবে তার রক্তলোহিত দক্ষিণ হস্তটি।
অথবা ধরো, আজ আমরা যারা এক গৌরবময় যুদ্ধের পরিকল্পনা করছি, এবং যে যুদ্ধে প্ররোচিত করছি সকলকে সেই আমাদের মাথার উপর যদি নরকের আকাশখানা সহসা প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠে ভেঙে পড়ে, যদি আমাদের আবার সেই জ্বলন্ত সমুদ্রের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে থাকতে হয়, যদি দেবতাদের দ্বারা নিক্ষিপ্ত প্রস্তরের সঙ্গে গ্রথিত থাকতে হয় আমাদের, যদি আমাদের যুগ যুগ ধরে আশাহীন, ভরসাহীন, বিশ্রামহীন। ও শৃঙ্খলিত অবস্থায় দিন যাপন করতে হয়, তাহলে আমাদের জয়ের গৌরব যাবে কোথায়? সে অবস্থা হবে আরও খারাপ আমাদের পক্ষে।
আমার কণ্ঠ তাই গোপন অথবা প্রকাশ্য যুদ্ধের বিরুদ্ধে ধ্বনিত হবে। যে শক্তি সর্বশক্তিমান, সর্বদপী, যে শক্তি এক স্থান থেকে সকল স্থানের সকল কিছু দেখতে পায়, সে শক্তিকে কেমন করে প্রতারিত করব আমরা? যে শক্তি স্বর্গ থেকে আমাদের বিতাড়িত করে স্বর্গ থেকে আমাদের সকল চক্রান্তজাল লক্ষ্য করছে এবং উপহাস করছে, সে শক্তি শুধু আমাদের বাহিনীর প্রতিরোধই করবে না, আমাদের সমস্ত চক্রান্তকে আগে থেকেই ব্যর্থ করে দেবে। আমাদের উচ্চাভিলাষকে পদদলিত করে দিয়ে আমাদের আবার বিতাড়িত করবে স্বর্গলোক থেকে। তাহলে আবার আমাদের সারাজীবন কষ্ট করে যেতে হবে। সারাজীবন আমাদের পীড়ন সহ্য করে যেতে হবে। সুতরাং বর্তমানে আমরা যে অবস্থায় আছি সেই অবস্থাই ভাল সুতরাং আমার পরামর্শ হচ্ছে এই যে, যে অমোঘ সর্বশক্তিমান শক্তির বিধানে আমাদের এই পতন ঘটেছে, বিজেতার অভিলাষ জয়যুক্ত হয়েছে সেই শক্তিকেই মেনে নিতে হবে অপ্রতিবাদে। সেই শক্তির বিরোধিতা করে কোন লাভ হবে না। যেহেতু শক্তিতে আমরা বিজেতার সমকক্ষতা অর্জন করতে পারিনি, সেইহেতু নির্বিবাদে আমাদের কষ্ট করে যেতেই হবে। তাছাড়া যে বিধানের বশে আমাদের পতন ঘটেছে সেই বিধানকে অন্যায়ই বা বলি কি করে?
আজ আমাদের এই সমস্যায় পড়তে হত না যদি আমরা এতবড় এক বিরাট শক্তির সঙ্গে বিরোধিতা করার ব্যাপারে আমাদের বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে পারতাম। একথা ভাবতে আমার হাসি পায় যে, আগে যারা এক সামরিক বীরত্ব প্রদর্শনে জন্য উদ্ধত ও অতিসাহসী হয়ে উঠেছে তারা যদি জানতে পারে তাদের সে বীরত্ব ব্যর্থ হলে বিজেতার নির্মম বিধানে আবার তাদের নির্বাসন, অপমান ও বন্দীত্বের বন্ধন-বেদনা ভোগ করে যেতে হবে, তাহলে তাদের সমস্ত ঔদ্ধত্য সঙ্কুচিত হয়ে উঠত মুহূর্তে।