–কী বললে?
–একটি ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন।
জুতোর উপর থেকে চোখ একবার উপরে উঠলো বটে, একপলকের জন্য, হাত কিন্তু কাজ করতেই থাকলো।
ডিফার্জ বললো-জুতোটা ভদ্রলোককে দেখান না! ঠিক হচ্ছে কি না, বলতে পারবেন ইনি! এই বলেই সে জুতোটা তুলে নিয়ে লরীর হাতে দিয়ে আবার বললো–এ জুতোটা কী জুতো, বলুন না ভদ্রলোককে!
এবারে একেবারে অনেকক্ষণ পর্যন্ত বৃদ্ধ নীরব, তারপর উত্তর হলো–কী তুমি জিজ্ঞাসা করেছিলে, ভুলে যাচ্ছি আমি।…কী বলছিলে?
–আমি বলছিলাম–এ জুতোটা কী জুতো, বলুন না এঁকে!
–এটা মেয়েদের জুতো। তরুণীদের বেড়াবার জুতো, আজকালকার ফ্যাশান এইরকমই। ও ফ্যাশান আমি কখনো চোখে দেখিনি, তবে একটা নমুনা দেখেছিলাম।
ডিফার্জ বললো–যিনি তৈরি করছিলেন, তার নামও জানতে চান এই ভদ্রলোক।
হাতে জুতো নেই, একবার ডান হাতের কব্জি বাঁ হাতে, এবং বাঁ হাতের কব্জি ডান হাতে নিয়ে যেন নাড়ী টিপতে লাগলেন বৃদ্ধ। তারপর গালের দাড়িতে বুলোতে লাগলেন হাত…এক মুহূর্ত বিরাম নেই তার। মনটা ভরে আছে আঁধারে, দীর্ঘ দিনের জমাট আঁধার। ডিফার্জের কথা বিজলীর ঝিলিকের মত সে-আঁধার এক একবার চিরে দিয়ে যাচ্ছে বটে, কিন্তু পরের মুহূর্তেই সারা অন্তর আগের মতই জমাট অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে আবার। তাকে সেখান থেকে তুলে আনা সহজ নয়। দুর্বল রোগী যখন মূর্ছা যায়, তখন তার চেতনা ফিরিয়ে আনা শক্ত। যে লোক মরতে বসেছে, সংসারের খুঁটিনাটির ব্যাপারে তার আগ্রহ ক্ষণিকের জন্য জাগিয়ে তোলা আরও শক্ত। কিন্তু ও সবের চাইতেও বুঝি শক্ত এই সব-ভুলে-যাওয়া বৃদ্ধের মনে স্মৃতি জাগিয়ে তোলা। অন্তত মিঃ লরীর তো তাই মনে হল।
কিন্তু যতই শক্ত হক, সেই চেষ্টাই তবু করতে হবে এখন ডিফার্জ, মিঃ লরী আর লুসী ম্যানেটকে।
ডিফার্জ এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে–ভদ্রলোকেরা আপনার নামটা জানতে চাইছেন।
বৃদ্ধ নীরব। ডিফার্জ তখন আবার জিজ্ঞাসা করে।
–আমার নাম…আমার নাম হলো ১০৫, নর্থ টাওয়ার।
–সে কি!
–হ্যা…১০৫, নর্থ টাওয়ার।
একটা ক্লান্তির শব্দ। দীর্ঘশ্বাস নয়, কাতর কোন উক্তি নয়! দেহ-মন যে একটা দারুণ ক্লান্তির ভারে ভেঙে পড়েছে, বাইরে তারই একটুকুন একটা প্রকাশ ছোট্ট একটা অস্পষ্ট শব্দের ভিতর দিয়ে! শব্দটা বেরুলো মুখ থেকে। তারপরই আবার কাজ শুরু। কিন্তু তার মনোযোগ আবার ভঙ্গ হল, এবারে ডিফার্জের কথা নয়, প্রশ্ন এলো মিঃ লরীর কাছ থেকে।
–আপনি কি চিরদিনই জুতো তৈরি করছেন?
ঘোলাটে দুটো চোখ একবার তাকালো ডিফার্জের দিকে, যেন ডিফার্জকে বলতে চায়–এ প্রশ্নের উত্তর তুমি দাও। কিন্তু ডিফার্জ নীরব। তখন বৃদ্ধের দৃষ্টি মিঃ লরীর দিকে ফিরলো।
–আমি চিরদিন জুতো তৈরি করছি কি না? না, তা করিনি। এ আমি এখানেই শিখেছি। নিজে নিজেই শিখেছি। শিখবার অনুমতি অবশ্য নিয়েছিলাম আমি–
বলতে-বলতেই আবার ডান হাতে বাঁ হাতের কব্জি, বাঁ হাতের ভিতর ডান হাতের কব্জি–আর দাড়িতে হাত বুলোনো। তারপর দৃষ্টি আবার পড়লো এসে মিঃ লরীর মুখের উপর। এক-পলক সে মুখখানি দেখে নিয়ে হঠাৎই যেন চমকে উঠলেন বৃদ্ধ, মনে পড়ে গেল মিঃ লরীর প্রশ্ন, আর সে-প্রশ্নের উত্তর দিতে-দিতে তার থেমে যাওয়া। কী-যেন গল্প তিনি রাত্রিবেলা বলতে শুরু করেছিলেন; বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। তারপর জেগে উঠলেন ভোরবেলায়, আর জেগে উঠেই সেই অর্ধেক-বলা গল্পের খেই ধরে নতুন করে বলতে শুরু করলেন–
–হ্যাঁ, আমি অনুমতি নিয়ে নিজে নিজেই শিখেছি এটা। অনেক দিনের চেষ্টায় একটু-একটু করে শিখতে হয়েছে। তারপর থেকে বরাবরই করছি এই কাজ। এই বলে বৃদ্ধ মিঃ লরীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। একখানা জুতো তখনও মিঃ লরীর হাতেই রয়েছে। সেখানা ফিরে পাওয়ার জন্যই হাত বাড়ানো। জুতো ফেরত দিয়ে মিঃ লরী বললেন :
মঁসিয়ে ম্যানেট! আমায় কি একটুও মনে পড়ে না আপনার?
হাতের জুতো হাত থেকে পড়ে গেল বৃদ্ধের। প্রশ্নকর্তার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে বসে রইলেন তিনি।
ডিফার্জ তার হাতের উপর হাত রেখে বললো–মঁসিয়ে ম্যানেট, এই লোকটির কথা কি কিছুই মনে পড়ে না আপনার? ওঁকে দেখুন ভাল করে! কোন ব্যাঙ্কারকে নিতেন কি আপনি পুরোনো দিনে? কোন ব্যবসাকর্মের কথা মনে পড়ে–আগেকার পুরোনো দিনের? আপনার কোন আত্মীয়-স্বজনের কথা?
বহু, বহু বৎসরের নির্জন কারাকক্ষের বন্দী নীরবে স্থির নয়নে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখেন–একবার ডিফার্জকে, আর একবার মিঃ লরীকে–তাঁর স্মৃতিকে আড়াল করে, যে কালো কুয়াশার পর্দা ঝুলছে আজ বহু বৎসর ধরে, তা যেন হঠাৎ কোথায় একটুখানি ফাঁক হয়ে যায় এক লহমার জন্য। বহুদিনের মুছে-যাওয়া, নিবে-যাওয়া চেতনার ঝিলিক যেন কপালের মাঝখান থেকে একবার এক-মুহূর্তের জন্য ফুটে উঠলো চকিত দীপ্তি নিয়ে। তারপরই সে আলোর উপর ঘনিয়ে এলো আবার বিস্মৃতির কালো মেঘ! ম্লান হয়ে গেল স্মৃতির সে ক্ষণিক আলো,–নিবে গেল, মুছে গেল তা একেবারে। গেল বটে, কিন্তু সে যে এসেছিল–তাতে সন্দেহ নেই। মিঃ লরীর আর কোন সন্দেহ নেই যে, ইনিই ডাক্তার ম্যানেট।
ডিফার্জ ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলো–আপনি কি চিনতে পেরেছেন ওঁকে?
–হ্যাঁ। এক মুহূর্তের জন্য। আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম, কিন্তু অবশে পেয়েছি দেখতে। এক মুহূর্তের জন্য হলেও, পেয়েছি দেখতে সেই অতিপরিচিত মুখখানি। ইনিই ডাক্তার ম্যানেট!