সিঁড়ির মাঝপথে দু’বার বিশ্রামের জন্য থেমে, অবশেষে ওঁরা এসে সিঁড়ির মাথায় পৌঁছুলেন। সেখান থেকেও আবার একটা সরু কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হলো একটা চিলে কুঠুরিতে। তার দোর তালাবন্ধ। আর, দোরের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে সেই তিনটি জ্যাস, একটু আগে যাদের কথা কইতে দেখা গিয়েছিল ডিফার্জের সঙ্গে। ডিফার্জের পিছনে দু’জন অপরিচিত লোক দেখে ওরা তাড়াতাড়ি পাশ কাটিয়ে নেমে চলে গেল। মিঃ লরী রুষ্টভাবে ডিফার্জকে জিজ্ঞাসা করলেন–তুমি কি লোক ডেকে-ডেকে আনো নাকি মঁসিয়ে ম্যানেটকে দেখবার জন্য?
ডিফার্জ উত্তর করলো–বিশেষ-বিশেষ লোককে আনি বৈকি ওঁর অবস্থা দেখবার জন্য।
–বিশেষ্য-বিশেষ? কী রকম?–প্রশ্ন করলেন মিঃ লরী।
— বিশেষ লোক, অর্থাৎ তাদের নাম হবে জ্যাক্স্, আমারই মত। আপনি ইংরেজ, ওসব বুঝবেন না। ফরাসীদেশের পক্ষে কী যে এখন প্রয়োজন, তা আমার চেয়ে আপনার ভালো জানবার কথা নয়!–এই কথা বলেই আর উত্তরের অপেক্ষা না । করে দরজার উপর জোরে জোরে বার কয়েক আঘাত করলো ডিফার্জ। যেন, ঘরের ভিতরকার লোকটির মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায় সে এইভাবে। তারপর সে তালা খুলে ফেললো। ঘরের ভিতরে এগিয়ে গিয়ে কী-যেন একটা কথা বললো সে। অতি ক্ষীণ স্বরে একটা উত্তরও শোনা গেল সে-কথার। মিঃ লরী প্রবেশ করলেন, লুসী ম্যানেটকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন, নইলে লুসীর পক্ষে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হতো না হয়তো।
লুসী বললো–আমার ভয় করছে!
মিঃ লরী বললেন–ভয় কি? কিসের ভয়?
লুসী কানে-কানে বলে–কি জানি, কি দেখবো।
ঘরখানা একেবারে ছোট এবং অন্ধকার। এক দিকের একটা জানলা দিয়ে সামান্য আলো এসে পড়েছে ভিতরে। ভালো করে জানলা খুলে দিলে আরও আলো আসতে পারতো অবশ্য, কিন্তু তা খোলা হয়নি। হয়তো এ-ঘরের অধিবাসীর চোখে বেশি আলো সহ্য হয় না বলেই।
সেই সামান্য আলোতে একখানা নিচু বেঞ্চিতে বসে এক পকেশ বৃদ্ধ আপন মনে জুতো সেলাই করছে।
ডিফার্জ বললো–সুপ্রভাত!
বৃদ্ধের মাথাটা এক সেকেন্ডের জন্য একটুখানি উঁচু হল, তারপর তার অতি ক্ষীণস্বর ভেসে এলো যেন অতি দূর থেকে–সুপ্রভাত!
–খুবই পরিশ্রম করছেন তো?–বললো ডিফার্জ।
অনেকক্ষণ কোন উত্তর নাই। অবশেষে আর-একবার সেই নতমস্তক উঁচু হল– এক সেকেন্ডের জন্য, এবং সেই স্বর আবার শোনা গেল-হা, আমি কাজ করছি! এবারে দুটি ঘোলাটে কোটরগত চক্ষু এক মুহূর্তের জন্য চেয়ে দেখলো-ডিফার্জের দিকে। তারপরে আবার নুয়ে পড়লো জুতো সেলাইয়ের উপর।
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর ডিফার্জ বললো–আর একটু বেশি করে খুলে দিতে চাই এই জানলাটা, বেশি আলোতে আপনার অসুবিধে হবে কি?
–কী বলছো?
–আর একটু আলো সহ্য করতে পারবেন কি?
–আলো আনো যদি, আমায় সহ্য করতেই হবে!–শেষ দু’টি কথার উপরে। আপনা থেকেই যে জোর পড়লো একটু, তা বোধ হয় বৃদ্ধ বুঝতেই পারলেন না। জানলাটা আর-একটু বেশি করে খুলে দিলো ডিফার্জ। অমনি জোরালো আলোর ঝলকে ঘর ভরে উঠলো। সেই আলোয় এইবার গৃহের বাসিন্দাটিকে বেশ ভালো ভাবে লক্ষ্য করা সম্ভব হল। অর্ধেকটা-সেলাই-করা একটা জুতো কোলে নিয়ে তিনি বসে আছেন। বেশি আলো তিনি অনেকদিন চোখে দেখেননি। হঠাৎ সেই বেশি আলোর ভিতর পড়ে তার চোখ জ্বালা করছিল বোধ হয়, তাই একখানা হাত আড়াল করে ধরেছেন চোখের উপর। জুতা-সেলাইয়ের কিছু যন্ত্রপাতি এবং কয়েক টুকরো চামড়া পড়ে আছে তার পায়ের কাছে। সাদা দাড়ি যেমন-তেমন করে ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। শীর্ণ কপালের নিচে অতিরিক্ত রকম বড় দুটো চোখ। একে তো সে চোখ স্বভাবতই বড়, তার উপর মুখের শীর্ণতা আর মাথার এলোমেলো চুলের রাশ এ-দুয়ের দরুন আরো বেশি বড়ো দেখাচ্ছে। জামা-কাপড় শত জায়গায় ছেঁড়া। শার্টের গলা খোলা; তার নিচে থেকে বুকের হাড়-পাঁজর গুনে নেওয়া যায়। তার গায়ের চামড়া, পরিধানের কাপড়, পায়ের মোজা–এ-সবেতে রৌদ্র-বাতাস লাগেনি বহুদিন; সবই বিশ্রী রকমের নোংরা আর হলদে হয়ে গেছে–কোষ্টা চামড়া আর কোন্টা কাপড়–তা চিনে বার করা শক্ত।
যে-হাতখানি দিয়ে আলো আড়াল করেছিলেন বৃদ্ধ, তার হাড় পর্যন্ত যেন স্বচ্ছ দেখাচ্ছিল সেই আলোর ভিতর। কাজ বন্ধ করে একদম চুপচাপ তিনি সামনের দিকে তাকিয়ে রইলেন, লক্ষ্যহীন দৃষ্টি তার চোখে। কথা শুনলে কোন্দিকে তাকাতে হবে, তা যেন হঠাৎ ঠাহর পান না তিনি! একবার ডাইনে, একবার বাঁয়ে চোখ ফিরিয়ে খুঁজতে থাকেন–শব্দটা এলো কোথা থেকে!
ডিফার্জ বললো–আপনি কি ঐ জুতো জোড়া আজই শেষ করতে চান? প্রশ্ন করেই সে মিঃ লরীকে ইশারা করলো কাছে আসবার জন্য।
–কী বললে তুমি?
–জুতোটা কি আজই শেষ করতে চান?
–না, শেষ করতেই চাই–এমন কিছু নয়। তবে হয়ে যেতে পারে। এই বলে তিনি আবার কাজে হাত দিলেন।
মিঃ লরী ধীরে-ধীরে এগিয়ে এলেন। কুমারী ম্যানেট দরজার পাশেই অপেক্ষা করতে লাগলো। মিঃ লরী ডিফার্জের পাশে এসে দাঁড়াবার মিনিট-দুই পরে বৃদ্ধ আবার মুখ তুলে চাইলেন। একজন লোকের জায়গায় দু’জন দেখেও কিছুমাত্র বিস্ময় প্রকাশ করলেন না তিনি, একবার কেবল তার হাতের আঙুল উঠলো গিয়ে ঠোঁটের কাছে। আঙুল এবং ঠোঁট দুই-ই বর্ণহীন ফ্যাকাসে।
ডিফার্জ বললো–আপনার সঙ্গে এক ভদ্রলোক দেখা করতে এসেছেন।