আজ কিন্তু বিনা পয়সায় মদ খাওয়ার এই সুযোগ পেয়ে পল্লীর নারী-পুরুষ শিশু-বৃদ্ধ সবাই, তা আকণ্ঠ পান করে নিচ্ছে। উঁচু-নিচু পাথরের রাস্তার ছোট-বড় গর্তগুলি মদের চৌবাচ্চায় পরিণত হয়েছে। তা থেকে আঁজলা ভরে-ভরে পান করেছে ওরা সাধ মিটিয়ে। কেউবা পেয়ালা ভর্তি করে ঢালছে বালতির ভিতর, কেউ আবার রুমাল ভিজিয়ে তাই নিংড়ে দিচ্ছে শিশুর মুখে। একটা উৎসব চলেছে যেন পাড়ার ভিতর। ছুটোছুটি, হাসাহাসি,নাচতেও শুরু করেছে কেউ-কেউ হাত ধরাধরি করে।
দোকানের দোরে দাঁড়িয়ে ডিফার্জ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে পাড়ার লোকদের এই মাতামাতি। পিপে ভেঙেছে, সেটা আড়তদারের লোকসান, ডিফার্জের নয়। তাই এত বড় লোকসান দেখেও সে বিচলিত হয়নি। সে বরং খুশিই হয়েছে এতে। পাড়ার গরিবেরা একটু আনন্দ পায় যদি তো পাক না। পয়সা দিয়ে খাবার মত অবস্থা তো ওদের নয়।
অবশেষে রাস্তার গর্তে মদ আর যখন রইলো না, সেই সময় আধা-মাতাল একটা নোংরা চেহারার লোক আঙুলের ডগায় একটুখানি মদ লাগিয়ে পাশের বাড়ির দেয়ালের গায়ে লিখলো
“রক্ত! রক্ত!”
লেখাটা চোখে পড়া মাত্র ধীর শান্ত ডিফার্জ হঠাৎ ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে ছুটে গেল সেখানে। হাতে করে কাদা তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘষে দিলো ঐ লেখার উপরে। তারপর লেখকের জামার উপরে নিজের কাদা-মাখা হাতখানা মুছতে-মুছতে তিরস্কার করে উঠলো–এ-সব রসিকতা করবার জায়গা কি রাস্তার উপরে, গ্যাসপার্ড? তোমায় দেখছি পাগলা গারদে পাঠানোর দরকার।
গ্যাসপার্ড হেসে ডিগবাজি খেতে-খেতে চলে গেল। ডিফার্জও ঢুকলো নিজের দোকানে। সেখানে বসে দোকানের তদ্বির করছে তার স্ত্রী মাদাম ডিফার্জ।
মাদাম ডিফার্জ সর্বদাই তার সেলাই নিয়ে ব্যস্ত। চোখ তুলে চাইবার অবসর নেই কোনদিকে। সেই সেলাইয়ের দিকে মনোযোগ দিয়ে কেউ লক্ষ্য করতে যদি, চক্ষুস্থির হয়ে যেতো তার। নানা রঙের সুতোয় কাপড়ের ভাঁজে-ভাঁজে শুধু নাম লেখা! হাজারো নাম! কাদের এ সব নাম, কে জানে তা!
স্বামীকে দেখে একটিবার মাত্র একটুখানি কাশতে শোনা গেল মাদাম ডিফার্জকে। স্বামীর মনে হলো–কেউ অপরিচিত ব্যক্তি এসেছে হয়তো, তা নইলে এমনভাবে অসময়ে কাশতো না তার স্ত্রী। সে খরিদ্দারদের ভিড়ের ভিতর মিশে গেল।
.
কেউ বসে আছে মদের গেলাস নিয়ে। কোথাও-বা দুই বন্ধু মিলে ডোমিনো খেলতে বসেছে। মাথা নেড়ে সবাইকে সম্ভাষণ জানালো ডিফার্জ, মাথা নেড়েই গ্রহণ করলো সবাইয়ের সম্ভাষণ। এক জায়গায় তিনজন লোক দাঁড়িয়ে নিম্নস্বরে কথা বলছিলো, গেলাস হাতে নিয়ে।
একজন বলছিলো–রাস্তার মদটা বোধ হয় সবই উদরস্থ করেছে পাড়ার লোকে, কি বলো জ্যাক্স্?
ডিফার্জ উত্তর করলো–হ্যাঁ, আর এক ফোঁটাও নেই জ্যাক্স্!
তিনমূর্তির ভিতর দ্বিতীয় বললো কালো রুটি খেয়ে-খেয়েই জীবন কাটে এদের! মদ তো বড় একটা পায় না খেতে…কি বলো জ্যাক্স্?
ডিফার্জ উত্তর করলো–ঠিকই বলেছো জ্যাক্স্!
তৃতীয় ব্যক্তি এবারে বললো–যা হোক তবু মুখ বদলাবার একটা সুযোগ পেলো আজ এই অভাগার দল। ঠিক কথা কি না..জ্যাক্স্?
ডিফার্জ উত্তর করলো–তা ঠিক বইকি, জ্যাক্স্।
তিন-তিনবার এই একই নামের আদান-প্রদান মাদাম ডিফার্জের মনোযোগ এড়ায়নি। প্রতিবারই ঈষৎ কুঁচকে উঠেছে তার ভ্র, আর, প্রতিবারই একটুখানি কেশেছে সে। ডিফার্জ তখন তোক তিনটিকে পরিচিত করে দিলো তার স্ত্রীর সঙ্গে। মাদাম ডিফার্জ একটুখানি মাথা নামিয়ে গ্রহণ করলো তাদের নমস্কার, আর সঙ্গে সঙ্গে চকিত দৃষ্টি দিয়ে দেখে নিলো একবার লোক তিনটিকে। তার সেলাই কিন্তু একটুও থামলো না, সমান ভাবেই চলতে লাগলো।
ডিফার্জ লোক তিনটিকে বললো–হ্যাঁ! যে ঘরখানা তোমরা দেখতে চাইছিলে, তা ছ’তলার উপর। সোজা উপরে উঠে গেলেই দেখতে পাবে।
মদের দাম চুকিয়ে দিয়ে ওরা উপরে উঠে গেল। ওরা চলে যেতেই একটি বৃদ্ধ ভদ্রলোক পিছনের বেঞ্চ থেকে উঠে এসে ডিফার্জকে বললেন–আমি কি একটা কথা বলতে পারি?
ডিফার্জ বললো–নিশ্চয়!
এক মিনিটের বেশি কথা হল না। প্রথম শব্দটি শুনেই চমকে উঠেছিল ডিফার্জ, তারপর বিশেষ মনোযোগ দিয়ে সে শুনলো ভদ্রলোকের কথাটি, শুনেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
দোকানের একদিকে বেঞ্চের উপর বছর-সতেরো বয়সের একটি তরুণী বসে ছিলেন। তাকে ডেকে নিয়ে বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিও বেরিয়ে গেলেন ডিফার্জের পিছনে পিছনে। মাদাম ডিফার্জ তখন আপন মনে সেলাই করে চলেছে…সে কিছুই দেখতে পেলো না বোধ হয়।
অনেক সিঁড়ি ভাঙতে হবে। ধীরে-ধীরে ওঠাই ভালো!–ডিফার্জ বেশ বিরক্ত সুরেই বললো কথাগুলো। তার পিছনে-পিছনে মিঃ লরী উঠছেন কুমারী ম্যানেটকে নিয়ে।
মিঃ লরী ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন–উনি কি একা?
ডিফার্জ বললো-একা ছাড়া তার কাছে কে থাকবে?
–সর্বদাই একা থাকেন তিনি?
–একা তো থাকেনই–তা ছাড়া সব সময় দরজা বন্ধ করে থাকেন…দীর্ঘ দিন কারাগারের খুপরিতে বন্দী থাকতে-থাকতে তার এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে যে, খোলা দরজা তিনি সহ্য করতে পারেন না!
–কিছু পরিবর্তন হয়নি?
–যেদিন প্রথম ব্যাস্টিলের লোক এসে আমার হাতে তুলে দিয়ে গেল ওঁকে, সেদিন যে-রকম দেখেছি ওঁর অবস্থা, আজও অবিকল তেমনি।
–খুবই বদলে গেছেন কি তিনি?
–বদলে? ভয়ানক একটা অস্বাভাবিক স্বরে ডিফার্জ বলে উঠলো কথাটা; আর সঙ্গে-সঙ্গে একটা ভীষণ শপথ উচ্চারণ করে দেয়ালে মারলো একটা ঘুষি। মিঃ লরীর আর বুঝতে বাকি রইলো না–মঁসিয়ে ম্যানেটের পরিবর্তনের রকমটা কী সাংঘাতিক।