মিঃ লরী উত্তর করলেন–হ্যাঁ, মেয়েই বটে। মেয়েটি দু’বছরের হতে-না-হতেই তার মাকেও সে হারালো। বুদ্ধিমতী জননী একটি কৌশল করে গিয়েছিলেন মরবার আগে। মেয়েকে জানিয়েছিলেন যে তার বাবা মৃত।
লুসীর সারা দেহ থেকে-থেকে কেঁপে উঠতে লাগলো। মিঃ লরী বললেন–স্বামী বেঁচে আছেন, অথচ তার কাছে যাবার উপায় নেই, তার সংবাদ নেবার উপায় নেই, এমনকি, কোথায় কতদূরে কীভাবে যে তাকে আটক করে রেখেছে দুশমনেরা, তা জানবারও কোন উপায় নেই!–এ-রকম অসহায় অবস্থায় পড়লে মানুষের মনে কি যে নিদারুণ যাতনা হয়, তা তিনি সেই দু’বছরে ভালো করেই বুঝতে পেরেছিলেন। মেয়েও যাতে বাপের জন্য ঐ-রকম যাতনা ভোগ করতে বাধ্য না হয়, তাই এ কৌশল তিনি করেছিলেন। কন্যা যাতে কোনদিন জানতে না পারে যে, তার পিতা জীবিত-ওকি! আপনি হাঁটু গেড়ে বসছেন কেন?
–আমায় দয়া করুন! সত্যি কথা বলুন আমায়! নতজানু হয়ে প্রার্থনা করছি আপনার কাছে–আপনি আমায় সত্য কথা বলুন–সকাতরে বলে উঠলো লুসী।
এ অবস্থায় কি যে করা যায়–বুঝতে না পেরে মিঃ লরী বললেন–বিপদে ফেললেন আপনি! আপনার অবস্থা দেখে আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। মাথা গুলিয়ে গেলে কথা কইবো কি করে?…নয় পেন্সকে নয় গুণ করলে কত হয় বলুন তো চট করে? কুড়ি গিনিতে কত শিলিং হয়, হিসাব করে বলুন তো? এঃ!–আপনি গুলিয়ে দিলেন সব!
বলতে-বলতে মিঃ লরী লুসীকে তুলে সযত্নে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। লুসীর অস্থিরভাবটা ধীরে-ধীরে কমে আসতে লাগলো। মিঃ লরীও মাথা ঠিক করে নিজের গল্প শুরু করলেন আবার।
–শুনুন তাহলে, কুমারী ম্যানেট। আপনার মা ঠিক এই ব্যবস্থাই করেছিলেন আপনার সম্বন্ধে। তারপর তিনি স্বর্গে গেলেন। ভগ্নহৃদয়ে মারা গেলেন বলেই আমার বিশ্বাস। আপনার পিতার জন্য সন্ধানের তার বিরাম ছিল না–জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। যাই হোক, তিনি মারা গেলেন। আপনি বড় হয়ে উঠলেন দিনে-দিনে…সুন্দরী, লাবণ্যময়ী, সুখী। আপনার পিতা বেঁচে আছেন, বেঁচেও মরার সামিল হয়েই আছেন, এ-কথা আপনি জানতে পারেননি কোনদিন। তা যদি পারতেন, তা হলে আপনার মায়ের মত আপনারও জীবন কাটত সংশয় আর যাতনার মাঝে। সে-যাতনার হাত থেকে রেহাই পেয়েছেন আপনি এতদিন–মায়ের আশীর্বাদে।
লুসীর সোনালী চুলের দিকে নতনেত্রে তাকিয়ে ছিলেন মিঃ লরী। তার চোখের চাহনির ভিতর দিয়ে গভীর স্নেহ ঝরে পড়ছিল যেন। হঠাৎ তার মনে হল–পিতার দুর্ভাগ্যের কথা গোড়া থেকে জানতে পারলে এই সতেরো বছরের মেয়েরই চুল হয়তো আজ সাদা হয়ে যেতো, যাতনার আগুনে পুড়ে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মিঃ লরী বললেন–না, সম্পত্তির কোন কথা নয়, ও-সম্বন্ধে নতুন কোন খবর নেই। কিন্তু…
তাঁর একখানা হাত লুসীর হাতের ভিতরে বন্দী রয়েছে বহুক্ষণ, তার উপর যেন বড় বেশি চাপ পড়তে লাগলো এইবার। ওদিকে লুসীর দুই ভ্রর মাঝখানের যে চিন্তারেখা তিনি লক্ষ্য করেছিলেন তা যেন স্থায়ী আসন গেড়ে বসেই রইলো সেখানে। শুধু সেই রেখাঁটির দিকে তাকিয়েই মিঃ লরী বুঝতে পারলেন–কী ভয়ানক বেদনা আর বিভীষিকায় ভরে গেছে কোমলা কুমারীর অন্তর। লুসীর চেতনাই যেন আধা আধি লোপ পেয়েছে; মিঃ লরীর কথাগুলো সে শুনছে বটে, কিন্তু তার কোন অর্থ সে বুঝতে পারছে না।
মিঃ লরী বললেন–হাঁ, পাওয়া গেছে…তাকে পাওয়া গেছে…বেঁচে আছেন তিনি। খুবই বদলেছেন–অবশ্য। শরীর-মন একেবারেই ভেঙে গেছে বলে মনে হয়। অবশ্য, আশা করছি তিনি হয়তো ভালোই আছেন। অন্তত বেঁচে যে আছেন, এটাও তো কম কথা নয়! ব্যাস্টিল থেকে বেরুবার পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়, তারই এক পুরাতন কর্মচারীর বাড়িতে। আমরা সেখানেই যাবো এখন। আমি যাচ্ছি–দেখি তাকে চিনতে পারি কি না, অর্থাৎ ইনিই সত্যি সত্যি আপনার পিতা কি না, সেটা সনাক্ত করবার ভার আমার। আর, আপনার ভার–আপনার স্নেহে ও সেবায় ওঁকে আবার বাঁচিয়ে ভোলা, জীবনের আনন্দ আর আশা ওঁকে আবার ফিরিয়ে দেওয়া…
সারা দেহে একটা শিহরন খেলে গেল লুসীর। সে যেন স্বপ্নের ঘোরেই বলে উঠলো–বাবা! আমার বাবা বেঁচে আছেন। তাকে আমি দেখতে পাবো?
সে-কথার উত্তর না দিয়ে মিঃ লরী বললেন–আর একটা জিনিস মনে রাখা দরকার কুমারী ম্যানেট! প্যারীতে রাজার যে কারাগার আছে ব্যাস্টিল,–নামে এ টেস্ অব টু সিটী কারাগার মাত্র হলেও সবদিক দিয়ে একটা দুর্গের মতই যা মজবুত–সেইখানেই আপনার পিতাকে আটক রেখেছিল শত্রুরা। কে সে শত্ৰু, কেন সে আটক রেখেছিল তাকে–এ-সব বিষয়ে সন্ধান নিতে যাওয়া বিপজ্জনক হবে এখন। আমাদের কাজ হবে—ওঁকে যত শীঘ্র সম্ভব ফ্রান্স থেকে সরিয়ে আনা। দেখুন, আমি ইংরেজ। ইংলক্সে রাজার প্রজা আমি, তার উপর টেলসন ব্যাঙ্কের পদস্থ কর্মচারী হিসেবে ফরাসীদেশে আমার কিছুটা সম্মানও আছে, কিন্তু ব্যাস্টিলের কথা মুখে উচ্চারণ করতে ভয় পাই আমি।–কিন্তু! একি! মিস ম্যানেট।…লুসী।
লুসী স্থির হয়েই বসেছিল–কিন্তু মিঃ লরীর কথা শুনতে-শুনতে কখন চেতনা লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল ভাগ্যহীনা বালিকার। চক্ষু দুটি বিস্ফারিত হয়ে শরীর মুখের দিকে তাকিয়েই আছে, দুই জ্বর মাঝখানটা তখনো আগের মতই কুঁচকে রয়েছে। সবই আগের মত আছে, নেই কেবল জ্ঞান। এমন শক্ত করে লুসী মিঃ লরীর হাত দু’খানা ধরেছিল যে, তার নড়বার উপায় ছিল না। নড়লেই লুসী মাটিতে পড়ে যাবে। সুতরাং সেইভাবে বসে বসেই মিঃ লরী হোটেলের দাসীদের ডাকতে লাগলেন-সাহায্যের জন্য।
২. ডিফার্জের দোকানে
প্যারী মহানগরীর এক গরিব পাড়া–সেন্ট আন্টইন। তারই এক রাস্তার ধারে ডিফার্জের মদের দোকান। দোকানের সামনে প্রকাণ্ড একটা মদের পিপে ভেঙে গুঁড়ো হয়ে গেছে। মদের স্রোত বইছে রাস্তায়। লাল মদে রাস্তাটা যেন রক্তনদী হয়ে গিয়েছে। অবশ্য, এমন দিনও এসেছিল দু’দিন পরেই, যখন সেন্ট আন্টইনের ঐ রাস্তা দিয়ে বাস্তবিকই বয়ে গিয়েছিল সত্যিকার রক্তের স্রোত। কিন্তু সে-কথা পরে।