মিঃ লরী নীরবে শুনে যান মেয়েটির কথা।
মেয়েটি বলে চলে–ব্যাঙ্কের চিঠিতে আমাকে বলা হয়েছে–এই হোটেলে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আপনি আমায় নিয়ে যাবেন প্যারী-নগরে…আমার। পিতার সেই বিষয়-আশয়ের সম্বন্ধে যেমন দরকার হবে, তেমনি ব্যবস্থা করবার জন্য।
মিঃ লরী বললেন–হ্যাঁ, সেই রকমই কথা আছে বটে!
মেয়েটির কথা তখনও শেষ হয়নি! সে বললো–চিঠিতে এ-কথাও লেখা ছিল–এ ব্যাপার সম্বন্ধে সব-কিছু আপনার কাছেই জানতে পাবো আমি।
মিঃ লরী কিভাবে তার কথাটা শুরু করবেন, তা ভেবে ঠিক করবার আগেই মেয়েটি আবার প্রশ্ন করলো–আচ্ছা, আপনি কি একেবারেই অপরিচিত আমার?
এ প্রশ্নের সোজা উত্তর না দিয়ে মিঃ লরী পাল্টা প্রশ্ন করলেন–অপরিচিত নই কি?
দারুণ দোনা-মনায় পড়লে মানুষের কপালে চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। মেয়েটির কপালেও দেখা দিল সেই রেখা। খুবই চিন্তিত ভাবে সে ধীরে-ধীরে বসে পড়লো চেয়ারে। এতক্ষণ সে দাঁড়িয়েই ছিল।
আগের কথা একেবারেই চাপা দিলেন মিঃ লরী। এই যেন নূতন পরিচয় হচ্ছে তাদের, সেই ভাবে বলতে শুরু করলেন, কুমারী ম্যানেট! আমি ব্যবসায়ী লোক।’ ব্যবসার কথাই আপনার সঙ্গে বলতে এসেছি। ব্যবসার ব্যাপারেই আমাদের এক মক্কেলের জীবনের কোন কোন ঘটনার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছি আমরা, সে সব কথাই বলতে চাই আপনাকে।
–মক্কেলের কথা!
–হ্যাঁ, মক্কেলের কথা। যারা আমাদের ব্যাঙ্কের সঙ্গে লেনদেন করেন, তাদেরই আমরা বলি মক্কেল। ভদ্রলোক ছিলেন ফরাসী বৈজ্ঞানিক, উঁচুদরের পণ্ডিত চিকিৎসক।
–তাঁর বাড়ি কি বোভেয়াতে?
-হ্যাঁ, আপনার পিতা মঁসিয়ে ম্যানেটের মত, এ ভদ্রলোকও ছিলেন বোভেয়াবাসী। মঁসিয়ে ম্যানেটের মত, এঁর খ্যাতি ছিল দেশে। প্যারীতে তার সঙ্গে আলাপ হয় আমার। বৈষয়িক লেনদেন নিয়েই আলাপ অবশ্য, তবে একটু গোপনীয় ব্যাপার ছিল এর ভিতর। আমি তখন আমাদের প্যারীর অফিসে। সে আজ কুড়ি বছর আগের কথা।
-কি বললেন? কুড়ি বছর আগের কথা?
–হ্যাঁ, কুড়ি বছর আগের কথা। তিনি বিবাহ করেন একটি ইংরেজ-মহিলাকে। তার সম্পত্তির ভার ছিল আমার উপর। ও-রকম অনেক ফরাসী-ভদ্রলোকেরই সম্পত্তির ভার আমায় নিতে হয়েছিল তখন ব্যাঙ্কের তরফ থেকে।–নিছক ব্যবসায়ের দিক দিয়েই সম্পর্ক, ওতে বন্ধুত্ব নেই, দরদ তো নেই-ই। সারাদিন ব্যাঙ্কে বসে মক্কেলের পর মক্কেলের হিসাব যেমন পরীক্ষা করি, ঠিকই তেমনই, মক্কেলের পর মক্কেলের বৈষয়িক সুবিধা কিসে হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখি আমি। ও আমার কর্তব্য। কর্তব্য করে যাওয়ার একটা কল আমি, আর কিছু নই। হ্যাঁ, যা বলছিলাম! সেই বোভেয়াবাসী ভদ্রলোক মারা গেলেন। যদি না যেতেন–ওকি! চমকে উঠছেন কেন?
লুসী সত্যিই চমকে উঠে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মিঃ লরীর হাত, নিজের দু’হাত দিয়ে। মিঃ লরী বুঝতে পারলেন, লুসীর মনে ভয় হয়েছে, যদিও কিসের ভয় তা সে জানে না। তাই তাকে সাহস দেবার জন্যে বাপ যেমন মেয়ের হাত ধরে তেমনি ভাবে তার হাত চেপে ধরে শান্তভাবেই বলতে থাকেন–
–হ্যাঁ, যা বলছিলাম! ঐ ভদ্রলোক যদি মারা না যেতেন! মিস্ ম্যানেট, আপনি মনে মনে একটা ধারণা গড়ে তুলবার চেষ্টা করুন। ধারণা করুন যে ভদ্রলোকটি মারা যাননি, মারা যাওয়ার বদলে তিনি হঠাৎ হারিয়ে গেছেন, অসাধারণ শক্তিমান কোন শত্রু তাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে অতি গোপন জায়গায় এমন ভাবে লুকিয়ে রেখেছে যে তার কোন খোঁজ তার আত্মীয়-বন্ধুরা শত চেষ্টাতেও পাচ্ছে না! ধারণা করতে পারছেন? তাহলে এখন বুঝে দেখুন যে সেই অভাগা ভদ্রলোকটির কী অবস্থা!
এই পর্যন্ত বলে একটু থামলেন লরী, বোধ হয় মিস্ ম্যানেটকে তৈরি হবার সময় দেওয়ার জন্য। তারপর আগের চেয়ে নিচু গলায় বললেন–ঐ বোভেয়াবাসী ডাক্তারটির যে অবস্থা আপনি ধারণা করতে পেরেছেন, ঠিক সেই অবস্থাই ঘটেছিল ডাক্তার ম্যানেটের, আপনার শিত।
লুসী ম্যানেট তাকিয়ে আছে। তার চোখের চাউনিতে ভয় আর সংশয় মাখামাখি। সে-অসহায় দৃষ্টি দেখে দুঃখ হল মিঃ লরীর। কিন্তু দুঃখ পেয়ে কথা চেপে গেলে তো চলবে না। তিনি আবার বলতে লাগলেন–হ্যাঁ, এ-রকম ব্যাপার ঘটে ফরাসীদেশে…প্রচুরই ঘটে! ফ্রান্সের যাঁরা ধনী মানী প্রবল জমিদার–তারা ইচ্ছে। করলেই, যে-কোন ব্যক্তিকে ব্যাস্টিল কারাগারে আবদ্ধ করতে পারতেন, যা এখনও পারেন–সারা জীবনের মত। এক-রকম সরকারী ফর্ম, ছাপানো কাগজ আছে। সেই ফর্ম পূরণ করে দিলেই হল। যার নাম লিখে দেওয়া হবে, সে অন্তর্ধান করবে সঙ্গে সঙ্গে। তার স্ত্রী-কন্যা গিয়ে রাজা-রানীর পায়ে নিজের কলিজা ছিঁড়ে উপড়ে দিলেও কিছু হবে না। আর আত্মীয়-স্বজনেরা সংবাদটি পর্যন্ত পাবে না যে, সে অভাগা বেঁচে আছে না মরে গেছে। এ-রকম ঘটনা ঘটে থাকে ফরাসীদেশে। যে ভাগ্যহীন বোভেয়াবাসী ডাক্তারের কথা আমি বলছিলাম আপনাকে, তার স্ত্রীর ভাগ্যে এমনি ঘটনাই ঘটেছিল। যদিও তার সাহস ছিল অসীম, ধৈর্যের তুলনা ছিল না। তা হলেও স্বামীর এ রকম অদ্ভুত ভাবে হারিয়ে যাওয়ার ব্যথা তিনি বেশিদিন সহ্য করতে পারলেন না। একটি সন্তানের জননী তিনি। সন্তানটি যখন জন্মগ্রহণ করল, তখন তার স্বামী অন্তর্ধান করেছেন…
বাধা দিয়ে নিচু গলায় লুসী বললো–সন্তানটি, বোধ হয় মেয়ে?