অফিসার রেগে উঠেছিলেন–এভরিমন্ডির দরুন ম্যানেটের শোকের কথা শুনে। সাধারণতন্ত্রের শত্রুর জন্য যে কাঁদে, সেও তো শত্রু সাধারণতন্ত্রের!–কিন্তু পরমুহূর্তেই চতুর লরীর মুখ থেকে বেরিয়ে পড়লো ডাক্তারের ব্যাস্টিলবাসের কাহিনী! অফিসার সামলে গেলেন! তাইতো! আঠারো বছর যে লোক ব্যাস্টিলবাস করেছে, তাকে–আর যাই হোক–সাধারণতন্ত্রের শত্রু বলা চলে না।
–লুসী এভরিমন্ডি! এভরিমন্ডির স্ত্রী!
অশ্রুমুখী লুসীকে দেখিয়ে দিলেন লরী, সঙ্গে-সঙ্গে বলতে ভুললেন না যে, লুসী–ম্যানেটের কন্যা!
–লুসী এভরিমন্ডি। এভরিমন্ডির কন্যা! শিশু লুসীকে দেখিয়ে দিলেন লরী।
–সিডনী কার্টন, এডভোকেট, ইংরেজ! গাড়ির এক কোণে কাপড় চাপা দিয়ে পড়ে আছেন কার্টন। অফিসার বললেন ভদ্রলোক কি অজ্ঞান হয়ে পড়েছেন?
–হ্যাঁ! এভরিমন্ডির বন্ধু কিনা! শেষ সাক্ষাতের পর থেকেই অচৈতন্য।
–জার্ভিস লরী! ব্যাঙ্কার! ইংরেজ!
–আমি।
–যেতে পারেন!
গাড়ি চলেছে। মাঝে-মাঝে ঘোড়া বদলানো হচ্ছে নির্দিষ্ট স্থানে। এক-একবার গাড়ি থামে, আর ভয়ে অস্থির হয়ে ওঠে ওরা! এ-গাড়ি কি আর ছাড়বে না? কখন আসবে নতুন ঘোড়া? যদি কেউ পেছন থেকে ধেয়ে আসে? যদি এই প্রকাণ্ড ছলনার কথা প্রকাশ হয়ে পড়ে থাকে? দেখুন, দেখুন, মিস্টার লরী! বাইরে মুখ বাড়িয়ে দেখুন-পেছনে ও শব্দ কিসের?
নাঃ, ও কিছু নয়!
হঠাৎ গাড়ির কোণ থেকে কাপড়ে-ঢাকা অচেতন কার্টন-বেশি ডার্নে বলে উঠলো–তোমার বুকে ওটা কি লুকিয়ে রেখেছো কার্টন? তাড়াতাড়ি তার মুখে হাত চাপা দিল রোরুদ্যমানা লুসী। কেউ শুনলো না তো? ধীরে ধীরে কেটে আসতে থাকে ডার্নের মূছার ঘোর।
গাড়ি চলছে। নাঃ, পিছনে আসেনি কেউ, পলাতক আসামী ধরবার জন্য। শুধু পিছনে ধাওয়া করে চলেছে পাগল হাওয়া, ধাওয়া করে চলেছে কালো-কালো মেঘ, নীল-আকাশে ভেসে ভেসে আসছে সঙ্গে সঙ্গে চতুর্থীর চাঁদ, ঘোর নিশীথিনী এলো চুল নাচিয়ে ছুটেছে পলাতক-আসামীর পিছনে-পিছনে। তাকিয়ে তাকিয়ে তাই দেখে লুসী, আর লুসীর অন্তর বলে ওঠে, ধন্যবাদ ভগবান–সাধারণতন্ত্রের সৈনিক কাউকে তো পিছনে দেখি না।
***
বেলা তিনটে বাজে! রাজপথে চলেছে ছ’খানা খোলা গাড়ি! বাহান্ন জন লোক সেই ছ’খানা গাড়িতে। যুবক, বৃদ্ধ, যুবতী, বৃদ্ধা–শিশুও দু-একজন। ধনী মানী জমিদার, মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী, দরিদ্র শ্রমিক–সব আছে সেই গাড়িতে।
অশ্বারোহী প্রহরী চলেছে ঐ ছ’খানা গাড়ি বেষ্টন করে। তরোয়াল উঁচিয়ে তারা দেখিয়ে দিচ্ছে একজন বিশেষ বন্দীকে! ঐ সেই এভরিমন্ডি! যে মুক্তি পেতে পেতে আবার ধরা পড়েছে। গিলোটিনকে ফাঁকি দেওয়া কি অত সোজা?
এভরিমন্ডি একটি ক্ষীণা বালিকার সঙ্গে কথা কইতে ব্যস্ত। অন্য কোনদিকে দৃষ্টি নেই তার! বালিকার বয়স আঠারো-উনিশের বেশি হবে না, একান্ত নিরীহ গোবেচারী সে! তাকেও ধরে এনেছে সাধারণতন্ত্রের শত্রু বলে! বিপ্লবের সেই পাগলামির দিনে, বিচার ছিল প্রহসন। যে-কেউ একজন এসে যা-হোক একটা অভিযোগ করলেই হল! তাহলেই গিলোটিন!
বালিকা কাতর হয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল এভরিমন্ডির পাশে! সে তাকে সান্ত্বনা দিয়েছে, আশা দিয়েছে, মৃত্যুর মুখোমুখি শান্তভাবে দাঁড়াবার সাহস দিয়েছে সে!
জনতার ভিতর কোলাহল উঠলো–নিপাত হোক এভরিমন্ডি! সাধারণতন্ত্রের শত্রু সবাই নিপাত হোক! অভিজাত বড়লোক নিপাত হোক সবাই!
একটা লোক বলে উঠল–থামো। থামো! এভরিমন্ডি তো নিজের সাজা মাথা পেতেই নিতে চলেছে! আর অভিশাপ কেন?
এ হল, মিঃ বরসাদ।
ঢং ঢং ঢং, তিনটে বাজলো!
ঘ্যাঁচ!–একটা মাথা গড়িয়ে পড়ল ঝুড়ির ভেতর।
ঘ্যাঁচ–আর একটা।
মাদাম ডিফার্জের সঙ্গিনীরা গিলোটিনের অদূরে বসে আছে চেয়ারে! হাতে তাদের উল আর কাঁটা! তারা গুনে যাচ্ছে–এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ…
ক্ষীণা বালিকাটি এভরিমন্ডিকে বলছে
–শেষ সময়ে তোমায় মিলিয়ে দিয়েছেন ভগবান! তোমায় পেয়ে তবে আমি ভগবানকে স্মরণ করতে পেরেছি।
–কিচ্ছু ভেবো না বোন! আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে শুধু! অন্য কোন দিকে তাকিয়ো না! এক সেকেন্ডে শেষ হয়ে যাবে। তারপর ভগবানের রাজ্য। আনন্দের দিন! কোন ভয় নেই!
এমন সময় এল মেয়েটির ডাক।
এভরিমন্ডি-রূপী সিডনীই ধীর-হস্তে ঠেলে দিল মেয়েটিকে। সিডনীর দিকে দুই আয়ত চক্ষুর দৃষ্টি রেখে সে অবনত করল নিজের মাথা! সে চক্ষুর দৃষ্টিতে ভয়ের লেশ নেই, আছে অশেষ বিশ্বাস।
সেই অন্তিম দৃষ্টির সামনে মেয়েটি স্পষ্ট দেখলো, সিডনীর পরিবর্তে তার সামনে দাঁড়িয়ে আলোক-মূর্তি যীশু, দুই হাত প্রসারিত করে। সিডনীর মুখ থেকে শান্ত কণ্ঠে উচ্চারিত হল যীশুর পরম আশ্বাস-বাণী,–আমিই পুনর্জীবন! আমিই অনন্ত জীবন! আমাতে যে বিশ্বাস করে, মরেও সে বাঁচবে! আমাতে যে বিশ্বাস করে, মৃত্যু নাই তার!
আনন্দে ভরে ওঠে মেয়েটির শেষ মুহূর্ত।
একটা ক্ষীণ শব্দ হয় শুধু। মেয়েটির ছিন্ন মাথা ঝুড়িতে গিয়ে পড়ে। উল বুনতে বুনতে মহিলারা গোনে–বাইশ!
এবার ডাক পড়লো, এভরিমন্ডি।
সিডনী বুক ফুলিয়ে গিলোটিনের তলায় গিয়ে দাঁড়ায়।
.
লক্ষ-কণ্ঠের স্তিমিত কলরব কানে আসে তার। চোখে পড়ে লক্ষ আবছা মুখ! উন্মত্ত জনতার উল্লাসধ্বনি তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ে…কিন্তু সিডনীর চোখের সামনে তখন জ্বলছে শুধু একটা আলো। কে যেন সিডনীর কানে কানে বলে, এস বন্ধু, এস ক্লান্ত পথিক!