লরীর বোধগম্য হল না–এ-সময়ে পাসপোর্টের কথা কেন? তবু তিনি পকেট থেকে বার করে দেখালেন–একতাড়া কাগজ। সেগুলি ফ্রান্স ছেড়ে যাওয়ার অনুমতিপত্র! লরী, ম্যানেট, লুসী, ডার্নে, লুসীর মেয়ে, লুসীর দাসী, লরীর ভৃত্য– সকলের জন্য এক-একখানা। সিডনী নিজের পকেট থেকে ঐরকমই আর-একখানা পাসপোর্ট বার করে লরীর হাতে দিল। সেখানিতে নাম লেখা–সিডনী কার্টন, এডভভাকেট, ইংরেজ!
জিজ্ঞাসু নেত্রে লরী চাইলেন সিডনীর পানে।
সিডনী বললো–কাল বেলা দু’টোর সময় ম্যানেটের বাড়িতে আমি আসবো। গাড়িতে আপনারা সব উঠে বসে থাকবেন। প্রতীক্ষা করবেন আমার জন্য। আমি যে অবস্থাই এসে পৌঁছেই, তখনই আমায় গাড়িতে তুলে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেবেন সীমান্তপানে। কারণ, বিলম্বে বিপদের আশঙ্কা আছে। ডানের প্রাণ যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই ডার্নের স্ত্রী-কন্যাকে বন্দী করবার জন্য প্রস্তুত হয়েছে–এভরিমন্ডিদের চিরশত্রু মাদাম ডিফার্জ।
এ পরামর্শ মনঃপূত হল লরীর। নিজের বা ম্যানেটের জন্য তিনি চিন্তিত নন, কিন্তু এভরিমল্ডি-বংশের শত্রুদের হাতে, লুসী ও তার কন্যার বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা যে খুবই আছে, তা বোঝা শক্ত নয়। গভীর বিষাদে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি স্বীকৃত হলেন–কাল বেলা দু’টোয় তিনি গাড়িতে সবাইকে তুলে নিয়ে প্রস্তুত থাকবেন প্যারী ছেড়ে যাবার জন্য, সিডনী এসে পৌঁছোলেই তাকে নিয়ে ছেড়ে দেবেন গাড়ি।
***
বেলা তিনটে! ডার্নে শুনেছেন–বেলা তিনটেয় গিলোটিনের ছুরি পড়বে তাঁর কণ্ঠে! তার একার নয়, আরো একান্ন জন বন্দীর কণ্ঠে! বাহান্ন জন শত্রু নিপাত হবে সাধারণতন্ত্রের, ঐ একই সময়ে।
বেলা তিনটে! সকাল থেকেই ডার্নের কানে ঘড়ির শব্দগুলো একটা বিশেষ বার্তা যেন শুনিয়ে শুনিয়ে যায়! সাতটা বাজলো। সাতটা বাজতে আর জীবনে শুনবে না ডানে! আটটা! আটটার বাজনা জন্মের শোধ এইবার শুনে নাও ডার্নে! নয়টা!–বারোটা! একটা….
ডার্নে দু’টোর সময়ই তৈরি থাকবেন স্থির করেছিলেন। যাতে কারারক্ষীরা এসে এক সেকেন্ডও দেরি করতে না বাধ্য হয়–মার্কুইস এভরিমন্ডির জন্য!
কিন্তু–এ-এ কী? সিডনী কার্টন? সিডনী কার্টন—লন্ডন থেকে প্যারীতে। এই সময়ে? যাই হোক, যা মনে করেই এসে থাকে কার্টন, একে দিয়ে লুসীকে একটা। শেষ খবর পাঠানো যেতে পারে হয়তো! একটা শেষ বিদায়বাণী!
দু’একটা আজে-বাজে কথা বললো কার্টন! যেমন চিরদিন বলে সে! তারপর সে ডার্নেকে বলল–একটা চিঠি লেখ তোমার স্ত্রীকে! আমি পৌঁছে দিতে পারব!
ডার্নে চিঠি লিখতে বসলেন। এ সময়ে মন স্থির করে চিঠি লেখা সহজ নয়। তবে, ডার্নের মন এ-অবস্থায়ও কতকটা স্থির। তা না হলে, এই বর্ষাধিক কালের অসহ্য অপমান আর যাতনায় কবে ভেঙে পড়তেন তিনি।
চিঠি লিখতে লিখতে হঠাৎ ডানের চোখে পড়লো সিডনী হাত দিয়েছে তার বুকের ভিতর। কী যেন টেনে বার করছে! কী অদ্ভুত! লোকটা কি অস্ত্র নিয়ে এসেছে এই হাজার পারাওলায় ঘেরা কারাদুর্গে? কী-জন্য? ডার্নে প্রশ্ন করলেন, চিঠি লেখা বন্ধ করে–ও কী তোমার হাতে, কার্টন?
কিন্তু উত্তর শোনবার সময় আর ল না ডার্নের। একখানা রুমাল এসে চাপা পড়লো ডানের নাকের উপর। ব্যাপার না বুঝতে পেরে, গিলোটিনমুখী ডার্নে সিডনীর হাত ছাড়াবার জন্য ধস্তাধস্তি করতে লাগলেন। কিন্তু হঠাৎই আক্রমণ করেছে সিডনী, তারপর ঔষধটার কাজও হয় খুব তাড়াতাড়ি। তিনি হাত ছাড়াতে পারলেন না। অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন।
সিডনী জানতো, জ্ঞান থাকতে ডানে কখনও অন্যের জীবন নষ্ট করে নিজের জীবন বাঁচাতে স্বীকার করবেন না। তাই এই কৌশল সিডনীর।
ঘরের দরজা বন্ধ করে নিজের বান, মায় টুপী জুতো রুমাল-ডার্নেকে পরিয়ে দিল সিডনী। ডার্নের চুলটি পর্যন্ত আঁচড়ে দিল নিজের ফ্যাশানে। তারপর ডার্নের কাপড়-জামা নিজে পরে দ্বারে টোকা দিল। বাইরেই পাহারায় আছে বরসাদ, সে খুললো দরজা।
সিডনী চোখ টিপে বললো—আমার বন্ধুটি মূৰ্ছা গেছেন প্রহরী! এঁকে বাইরে পাঠাবার ব্যবস্থা করো!
চোখ টিপেই বরদ সম্মতি জ্ঞাপন করলো। দু’জন প্রহরী এল তার আহ্বানে। তারা বরসাদের কথামত অচেতন ডার্নেকে বহন করে নিয়ে চললো দুর্গের বাইরে। দ্বার রুদ্ধ করে বরাদও চললো তাদের পিছনে। সিডনীর শেষ আদেশ-ডার্নেকে পৌঁছে দিতে হবে ম্যানেটের বাড়িতে বেনা দুটোর ভিতর। তা নইলে শেষ মুহূর্তেও সিডনী বক্সাদকে অভিযুক্ত করে যাবে সরকারি গোয়েন্দা বলে।
বরসাদ যেতে-যেতে উঁচু গলায় হেঁকে বলে গেল–তুমিও তৈরি হও এভরিমন্ডি! তিনটে বাজতে বাকি নেই বেশি!–ডার্নের বাহকেরা হেসে উঠলো সে রসিকতা শুনে।
***
সীমান্ত-পানে ছুটে চলেছে ঘোড়ার গf। সীমান্ত : এখানে যাত্রীদের কাগজপত্র পরীক্ষা হবে। গাড়ি থামলো। লরী নেমে এসে সমস্ত কাগজপত্র দিলেন অফিসারের হাতে। একে-একে নাম ডাকতে লাগলেন অফিসার!
–আলেকজান্ডার ম্যানেট!–ডাক্তার!
লরী দেখিয়ে দিলেন–গাড়ির এক কোণে বৃদ্ধ ডাক্তার নিচু গলায় কাতর স্বরে কেবলই গোঙাচ্ছেন, কেবলই গোঙাচ্ছেন…লরী বুঝিয়ে দিলেন–এভরিমন্ডির শ্বশুর কিনা উনি! এভরিমন্ডি এতক্ষণ গিলোটিনের তলায় নীত হয়েছে, সেই কল্পনাতেই কাতর হয়েছেন বৃদ্ধ। মনের দৃঢ়তা ওঁর নষ্ট হয়ে গেছে সেই আঠারো বছর ব্যাস্টিলবাসের ফলে!