হ্যাঁ, একটা কাজ করেছে সিডনী ইতিমধ্যে। সেই গুপ্তচর বরসাদ। সে এখন ফরাসী-সাধারণতন্ত্রে চাকরি করে। সেই বরসাদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করেছে সিডনী। লন্ডনের ওল্ড বেইলী কোর্টে যখন মামলা হয় ডার্নের, তখন এই বরসাদ ছিল সরকারপক্ষের সাক্ষী। সে যে গভর্নমেন্টের মাইনে-করা গোয়েন্দা, তার কাজই যে ছিল জনসাধারণের ভিতর ঘুরে-ঘুরে রাজদ্রোহীর সন্ধান করা, এটা একরকম প্রমাণই হয়ে গিয়েছিল সে-মামলায়। সিডনী সে-কথা জানতো। আজ বরসাদ ইংলন্ড থেকে তাড়িত হয়ে ফরাসী-সাধারণতন্ত্রের চাকরি নিয়েছে–প্রজাদরদী সেজে। তার পূর্ব-ইতিহাস যদি প্রকাশ হয়ে পড়ে, এই মুহূর্তে চাকরি তো যাবেই তার, এই মুহূর্হে বিদ্রোহীরা তাকে গিলোটিনের মুখে ফেলে দেবে।
হ্যাঁ, সিডনী জানে বরসাদের পূর্ব-ইতিহাস। সিডনী যদি বিরক্ত হয়, বত্সদের সর্বনাশ করতে পারে এক মিনিটে। ইংলন্ডের সরকারী-গোয়েন্দার একটিমাত্রই স্থান আছে ফরাসী-সাধারণতন্ত্রে। সে-স্থান হল, গিলোটিনের তলায়। কাজেই বাদ আজ সিডনীর আজ্ঞাবহ। এবং
এবং–বরসাদের চাকরি হল কনসিয়েরজারী কারাগারে। সেখানে সে প্রহরীদের একজন সর্দার। আর ঐ কনসিয়েরজারী কারাগারেই থাকে সেই সব বন্দীরা, যাদের উপর প্রাণদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। আজ ডার্নেও সেইখানেই।
ম্যানেটের প্রতীক্ষায় বসে থাকতে-থাকতে সিডনী চঞ্চল হয়ে উঠলো। ম্যানেট যা করবার, তা করুন! কিন্তু ধরে নেওয়া যাক, তিনি ফিরে এলেন ব্যর্থ হয়ে! তখন কী হবে? এই আসন্ন সর্বনাশ থেকে লুসীকে বাঁচাবার কোন উপায়ই কি সিডনীর হাতে নেই?
লরীকে সে বললো–আপনি বসুন, আমি ঘুরে আসছি!
সিডনী গেল বরসাদের সন্ধানে। তাকে খুঁজে বার করে অতি গোপনে, অতি সাবধানে সে তাকে বললো একটি কথা। একটি মিনতি, একটি অনুরোধ, একটি আদেশ! সে আদেশ যদি অবজ্ঞা করে বরসাদ,না! অবজ্ঞা করবার সাহস তার নেই, কেননা তাতে নিশ্চিত মৃত্যু বরসাদের!
কিন্তু সে-আদেশ পালন করলেও যে মৃত্যু থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে, তার ভরসা কী? এত-বড় বিপজ্জনক কাজের কল্পনা কি করে করলো সিডনী, তাই ভেবে পেলো না বেচারী গুপ্তচর!
কিন্তু সিডনী কঠোর, কোন কারণেই তার সংকল্প ত্যাগ করবে না। তার এ আদেশ মানতেই হবে বরসাদকে! নইলে চললো সিডনী বরসাদের পূর্ব-ইতিহাস প্রকাশ করে দিতে! বরসাদ ভেবে দেখলো–সিডনীর সাহায্য করলে, প্রাণ বাঁচলেও বাঁচতে পারে। কিন্তু সাহায্য না করলে প্রাণ যাবেই। অতএব–
বরসাদের সঙ্গে সমস্ত পরামর্শ স্থির করে, সিডনী গেল এক ওষুধের দোকানে। কয়েকটা ওষুধ সে কিনলো। বিক্রেতা সাবধান করে দিলো সিডনীকে—ওষুধগুলি একসাথে মিশিয়ে ফেলবেন না কিন্তু! তাতে কী আশঙ্কা আছে জানেন তো?
–জানি–বলে সিডনী বিদায় হল।
তারপর সিডনী গেল ডিফার্জের মদের দোকানে। এখানে সে যায় মাঝে-মাঝে। মার্কুইস এভরিমন্ডির সঙ্গে চেহারার আশ্চর্য মিল আছে এই ইংরেজের, তা সবাই জানে ডিফার্জের দোকানে। সবাইকে এ-কথাটা আগে থাকতে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন বিবেচনা করেছে সিডনী।
মদের দোকানে বসে রইলো বহুক্ষণ সিডনী। মদ খাবার ভানই করলো, কিন্তু খেলো খুব সামান্যই। আজ তার মাথা ঠিক রাখা প্রয়োজন। আজ মদ খেলে চলবে না। খবরের কাগজ আড়াল দিয়ে সুরাপানের ভানই করলো আজ সিডনী। অবশেষে মদটা মাটিতে ফেলে দিয়ে সে বেরিয়ে এল।
রাত্রি দ্বিতীয় প্রহর।
লরীর ঘরে তখনও লরী একা। তবে বেশিক্ষণ আর অপেক্ষা করতে হল না। ম্যানেট ধীরে-ধীরে সিঁড়িতে উঠছেন শোনা গেল। ধীরে-ধীরে তিনি ঘরে এসে ঢুকলেন।
খবর আর জিজ্ঞাসা করে জানতে হল না। ম্যানেটের চোখের পাগলের মত দৃষ্টি, তার কম্পিত পদক্ষেপ, তার উস্কোখুস্কো চুল–সব সমস্বরে ঘোষণা করলো– না, কিছু হয়নি, কিছু করতে পারিনি, কোন আশা দেয়নি কেউ!
কিন্তু সে যাই হোক, ম্যানেটের হল কী? তিনি পাগলের মত চারিদিকে চাইছেন কেন? কী খুঁজছেন তিনি? তার ভাব দেখে লরীর শঙ্কা হল–তিনি হয়তো ঠিক প্রকৃতিস্থ নেই!
লরীর মনে এক মহা আশঙ্কা জেগে উঠলো। তবে কি এই শোকের ধাক্কায় ম্যানেট আবার পাগল হয়ে যাবেন? কিছুক্ষণ কাতর ভাবে এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে, অতি ক্ষীণ স্বরে ডাক্তার ম্যানেট জিজ্ঞাসা করলেন–কোথায় গেল সেগুলো? আমার জুতো-সেলাইয়ের সরঞ্জামগুলো?
আকাশ ভেঙে পড়ল লরীর মাথায!
ম্যানেট আবার পাগল হয়ে গেছেন!
আবার তার মন ফিরে গেছে ব্যাস্টিলের ১০৫ নং গহ্বরে, যেখানে সারা দিনমান তাঁর একমাত্র কাজ ছিল, জুতো সেলাই করা! দীর্ঘ দশ বৎসরের সংসার-ধর্মের ইতিহাস এক নিমেষে তিনি ভুলে গেছেন, ভুলে গেছেন লুসীকে পর্যন্ত–যে-লুসী হল তার চোখের আলো, বুকের রক্ত, ইহ-পরকালের একমাত্র অবলম্বন।
লরী আর কার্টন তাকে ধরে শুইয়ে দিলেন সোফার উপরে, আগুনের পাশে!–এখনই আনিয়ে দিচ্ছি আপনার সেলাইয়ের সরঞ্জাম–এই বলে আশ্বাস দিলেন অবুঝ পাগলকে। পাগল শ্রান্ত দেহে ঘুমিয়ে পড়লো সেই সোফায় শুয়ে!
তখন সিডনী আর লরী পরস্পরের দিকে তাকালেন। লরীর চোখে শুধুই গভীর নৈরাশ্য। সিডনীর চোখে গভীর নৈরাশ্যের ভিতরও ক্ষীণ একটু উত্তেজনার আভাস!
সে বললো–হ্যাঁ, সবই শেষ হল বলা চলে। তবে যতক্ষণ শাস, ততক্ষণ আশ! কাল বেলা তিনটেয় ডার্নের শেষ নিশ্বাস পড়বার কথা! ততক্ষণ–দেখা যাক কি হয়! আপনার পাসপোর্টগুলি তৈরি আছে তো?